বাংলাদেশি পায়েলের অধরা স্বপ্নের মৃত্যু ভারতের পতিতাপল্লীতে

সাইফুজ্জামান সুমন
সাইফুজ্জামান সুমন সাইফুজ্জামান সুমন , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৫৯ পিএম, ১৩ জুলাই ২০১৭

মেঘাচ্ছন্ন এক সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নদীতে ছোট্ট একটি নৌকা অপেক্ষা করছে। সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো ১৬ বছরের কিশোরী পায়েলকে। নদীতে মাছ শিকারে ব্যস্ত মাঝিরা; কিন্তু সেদিন নৌকার মাঝিরা মাছ শিকারে ব্যস্ততা ছিল না। নৌকাটিতে ছিল মাছ ধরার জাল। সেই জালের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয় পায়েলকে। ভারতে নৃত্যশিল্পীর কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে তাকে নৌকায় চেপে ভারতে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেয় এক দালাল। 

বাংলাদেশি এই কিশোরীকে স্বপ্ন দেখানো হয় ঝলমলে এক জীবনের; যার কাজ হবে জমকালো অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করা। কয়েকদিন পরে মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার দূরের ভারতীয় শহর মহারাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের পুনের একটি যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হয় পায়েলকে। 

সেখানে তাকে একটি রুমে আটকে রেখে মারপিট ও নিপীড়ন করা হয়। সবেমাত্র ভোগান্তির শুরু হলেও শেষ এখানেই নয়; এরপর থেকে প্রতিনিয়ত তাকে অগণিত মানুষের সঙ্গে বিছানায় যেতে হয়। যৌনপল্লীতে বিক্রির ৯ মাস ১১ দিন পর উদ্ধার হয় পায়েল। এই কিশোরীকে নেয়া হয় পুনের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে, কেউ তাকে বাড়ি ফিরতে সহায়তা করবেন।

bangladeshi-child2 

প্রায় একই সময়ে পুনে থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কনস্যুলার প্রধান মোশারফ হোসাইন ভারতে আটকা পড়া পাচারের শিকার নারীদের দেশে ফেরত পাঠাতে ভ্রমণ পারমিটের ব্যবস্থা করেন। 

নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ২০১৫ সালের মার্চে যোগ দেন মোশারফ হোসাইন। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশি তরুণী এবং অনেক তরুণকে দেখেছি; যারা প্রচুর ভোগান্তিতে ছিল। দেশে ফেরার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ছিল তারা, কারণ আমাদের তদন্তের গতি ছিল ধীর। 

‘আমি দ্রুত কাজ শুরু করি এবং উদ্ধারকৃত মেয়েদের জন্য আরও সতর্কতার সঙ্গে কাজে হাত দেই। কেরালায় আমি তরুণীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি; যারা সাত বছর ধরে রাজ্য সরকারের আশ্রয় কেন্দ্রে আটকা আছে।’ 

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের যৌনপল্লীতে পাচারের শিকার বাংলাদেশি তরুণীদের দেশে প্রত্যাবর্তনে গত দুই বছর ধরে কাজের গতি বাড়ানোর মিশন শুরু করেন মোশারফ হোসাইন। গত বছর পুনের বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রেসকিউ ফাউন্ডেশনের একটিসহ দেশটির বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন তিনি।

bangladeshi-child2

দুই সপ্তাহ আগে পুনের ওই অলাভজনক ফাউন্ডেশনে পায়েলের দেখা পান বাংলাদেশি এই কর্মকর্তা। সেখানেই পায়েল তার জীবনের কাহিনি খুলে বলেন মোশারফ হোসাইনের কাছে। একই সঙ্গে তার গ্রামের ঠিকানাও দেন তাকে। 

গত সপ্তাহে পায়েলের ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করা হয়। আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের উদ্দেশে ভারত ত্যাগ করবেন তিনি। ‘আমার মা অনেক কান্নাকাটি করেছেন, যখন আমি তাকে বাড়ি ফেরার কথা বলেছি। আমি বলেছি, কয়েক মাস আগে খারাপ পরিস্থিতিতে ছিলাম, কিন্তু এখন ভালো আছি।’ 

পুনের ওই আশ্রয় কেন্দ্রে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে পায়েল বলেন, ‘আমি অনেক খুশি যে, আমি একটি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়িতে যাচ্ছি; যৌনপল্লী থেকে নয়।’ 

bangladeshi4

গতি বাড়ছে প্রত্যাবর্তনের

সাবেক ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মোশারফ হোসাইন এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৩৮ কিশোরী, তরুণী ও নারীকে ভারতের পতিতালয় থেকে উদ্ধারের পর দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন। তবে এদের অধিকাংশকেই উদ্ধার করা হয়েছিল ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল শহর মহারাষ্ট্র থেকে; বাংলাদেশ থেকে পাচারের শিকার অনেক তরুণীর আশ্রয় হয় এই রাজ্যে। 

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে তরুণীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ। ভারতে ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র তরুণী, শিশু, কিশোরী ও নারীদের টার্গেট করে পাচারকারীরা। 

উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বিক্রি করা হয় ভারতের কোনো যৌনপল্লীতে। এছাড়া এদের কিছু অংশকে বিক্রি করা হয় গৃহ দাসী হিসেবে। অনেককে উদ্ধার করা হলেও দুই দেশের মধ্যে আন্তঃদেশীয় টাস্কফোর্স গঠন দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকায় সহজে দেশে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয় না। 

সেভ দ্য চিলড্রেনের ভারতের পরিচালক জ্যোতি নেইল বলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা এগিয়ে আসায় প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হয়েছে। পাচারের শিকার তরুণীদের প্রত্যাবর্তনে মহারাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে কাজ করছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থা। 

এসআইএস/জেআইএম

প্রতিনিয়ত তাকে অগণিত মানুষের সঙ্গে বিছানায় যেতে হয়। যৌনপল্লীতে বিক্রির ৯ মাস ১১ দিন পর উদ্ধার হয় পায়েল

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।