‘আমাকে যৌনদাসী হিসেবে সাতবার বিক্রি করা হয়’


প্রকাশিত: ১১:৩৯ এএম, ০৪ জুলাই ২০১৭

ইরাকের উত্তরাঞ্চলের লালিশ গ্রামে কেউ জুতা পরেন না। গ্রামটিকে এত বেশি পবিত্র মনে করা হয় যে, এখানে ঘুরতে আসা সব পর্যটক খালি পায়ে রাস্তা হাঁটতে বাধ্য। একটি সংকীর্ণ উপত্যকার উপরে অবস্থিত কুর্দি সীমান্তের নিকটবর্তী উত্তর ইরাকের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত গ্রামটির সারি সারি মাজার ইয়াজিদি মতাদর্শের অনুসারীদের কাছে একটি সম্মানিত স্থান।

লালিশের প্রাণকেন্দ্রে ছোট্ট একটি গুহার মধ্যে রয়েছে জলাধার। এটির প্রবেশমুখ তুঁত গাছের ছায়ায় আচ্ছন্ন। লাল পাগড়ি পরিহিত এক ব্যক্তি লালিশের ওই জলাধারের দেখাশোনা করেন। এটি হচ্ছে পবিত্র শ্বেত বসন্ত, যেখানে সদ্যজাত শিশুকে নিয়ে আসা হয় ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানদের মতো ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য। লালিশের মাটি মিশ্রিত এই জলাধারের পানি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার জন্য ব্যবহার করা হয়।

এখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয় বসন্তকালে। আর এটি চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কিন্তু দুই বছর আগে সচরাচর নীরব থাকেন এমন কিছু নারী তরুণ ও শিশুদের সঙ্গে গুহায় যাতায়াতকারী পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগ দেয়।

Nour

সম্প্রতি এক বিকেলে এই নারীদের গম্ভীর এবং নীরব কয়েকটি গ্রুপ পবিত্র জলাধার থেকে উঠে সন্ধ্যার বাতাসে ভেজা শরীর শুকাচ্ছিলেন। এদের সকলেই জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (অাইএস) যৌনদাসী মার্কেট থেকে ফিরে এসেছেন; যেখানে নারীদের কেনা-বেচা করা হয়। লালিশ গ্রামের ওই গুহার ভেতরে তারা মাথা, মুখ ও শরীর ধুয়ে প্রার্থনা করছিলেন। এর মাধ্যমে তারা তাদের বাল্যকালে দীক্ষা নেয়া বিশ্বাসে ফিরে যান।

২৮ বছর বয়সী তরুণী নুর ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, লালিশে, আমরা মুক্তি পেয়েছি। নুর যখন এই কথা বলছিলেন তখন তার মুখে হালকা হাসির আভা ফুটে উঠলেও নিজের লুকায়িত দুঃখকে আড়াল করতে পারছিল না সেই হাসি। তার স্বামী এখনও নিখোঁজ। আইএস জঙ্গিদের হাতে ১৫ মাসের বন্দী জীবনের পর বর্তমানে তিন সন্তানসহ মানসিকভাবে অসুস্থ নুর।

লালিশের সাধারণ ও সামান্য ওই আনুষ্ঠানিকতা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে নুরের জন্য অত্যন্ত জরুরি। প্রকৃত নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানানোয় ছদ্মনাম নুর ব্যবহার করা হয়েছে। নিজেকে শুদ্ধ করতে পবিত্র ওই জলাধারে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়বার তিনি এসেছেন। নিজের জীবন পুনর্গঠনে সহায়তা করতে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন প্রায় তিনবার।Nourঅনুষ্ঠানে তাকে দেয়া সাদা রঙয়ের একটি স্কার্ফ দেখিয়ে নুর বলেন, এই সাদা কাপড়গুলো আমাকে আনন্দ দেয়। পবিত্র ওই জলাধারের পানি বাড়িতে নিয়ে যান। ইয়াজিদি ওই তরুণী বলেন, আমি অসংখ্যবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সন্তানদের জন্য জীবন চালিয়ে যাচ্ছি এখনো।

ইয়াজিদি মতাদর্শের ঐতিহ্যগত এসব আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন ২০১৪ সালের গ্রীস্মের আগেও অচিন্তনীয় ছিল। ওই বছরের আগস্টে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট সিরীয় সীমান্তে ইয়াজিদির আবাসভূমি সিনজারকে নতুন টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করে। সিনজারের পর্বত ও এর আশপাশের গ্রাম এবং শহরে অন্তত ৪০ হাজার ইয়াজিদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের অনেকেই জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের অন্যান্য অঞ্চলেও বসবাস করছে। গোপন বিশ্বাসের কারণে আইএস যোদ্ধারা ‘শয়তানের পূজারী’ মনে করে ইয়াজিদিদেরকে।

পুরুষ এবং বয়স্ক নারীদেরকে গণহত্যা করা হয়। তাদের মরদেহ নিক্ষেপ করা হয় গণকবরে; যা পর্বতের ফাঁকা স্থান পূরণ করছে। আইএসের যোদ্ধারা এখনো এসব এলাকার বড় একটি অংশে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। তরুণীদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ পরিস্থিতি। Nour
আইএস যোদ্ধারা সেখানে যৌন দাসত্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। আইএসের দাবি, অমুসলিমদেরকে ধর্ষণ ইবাদতের একটি অংশ। তারা বেশ কিছু শহরে যৌন বাজার প্রতিষ্ঠা করেছে; যেখানে তরুণী এমনকি ৯ বছরের শিশুদেরকেও নিলামে তোলা হয় যৌনদাসী হিসেবে। একবার কিনে নেয়ার পর আবারও তাদেরকে অনলাইনে বিক্রি করা হয়।

বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা স্মরণ করে নুর বলেন, ‘আমাকে সাতবার বিক্রি করা হয়েছিল। সেখানে আমার চেয়েও ভয়াবহ জীবন যাপন করছেন অসংখ্য নারী।’ তার তিন ও চার বছর বয়সী দুই মেয়ে রয়েছে। তৃতীয় সন্তান পেটে আসার সময় পুরো পরিবারের সঙ্গে তাকেও তুলে নেয়া হয়েছিল। দুই দিন পর তার স্বামীকেও নিয়ে যায় আইএস যোদ্ধারা; যিনি এখনো নিখোঁজ আছেন।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নুর তার তৃতীয় সন্তানের জন্ম দেন একটি বদ্ধ ঘরে। আরো দুই বন্দী নারী ধাত্রী হিসেবে তাকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার দুদিন পর জ্ঞান ফিরে পান তিনি। ‘তারা আমাকে গোসল করিয়েছিলেন। সেই সময় শীত থাকার কারণে তারা আমাকে কয়েকটি কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছিলেন। দীর্ঘ সময় পর বয়স্ক এক নারী আমাকে বলেন, জেগে ওঠো, তুমি ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছো। আমি কান্না করছিলাম; কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম না।’Nourগর্ভাবস্থা তাকে যৌন দাসত্ব থেকে রক্ষা করেছিল, কিন্তু মসুলের একটি কমিউনিটি সেন্টারে তিন সন্তানসহ তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘প্রত্যেকদিন জঙ্গিরা এসে আমাদেরকে দাঁড়িয়ে মাথায় স্কার্ফ পড়তে বলে। তারা নারীদের দিকে তাকিয়ে দেখে কে বেশি সুন্দরী। এমনকি নববিবাহিত হলেও তাকে নিয়ে যায় তারা। (সংক্ষেপিত)

দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে সাইফুজ্জামান সুমন।

এসআইএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।