জয় হোক ভোটের রাজনীতির


প্রকাশিত: ০১:৫৬ পিএম, ০২ জুন ২০১৭

ব্রিটেনে ২০০৫ সালের নির্বাচনে একটি পোস্টার ছাড়া হয়েছিল। যেখানে লেখা ছিল, অভিবাসন নিয়ে কথা বলা বর্ণবাদী কিছু নয়। আমরা যা ভাবছি আপনিও কি সেটা ভাবছেন?

বামপন্থী রাজনীতিবিদরা ওই পোস্টার ছাপানোর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কেন দলটি ওই পোস্টার ছেড়েছিল তার পিছনের কারণ কেউ কি খুঁজে দেখেছেন? পোস্টার ছাড়া দল কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনে জিততে পারল না ঠিকই; কিন্তু তাদের ভোট অনেক গুণ বেড়েছিল। সেই সঙ্গে তাদের বিশ্বাস জন্মেছিল, অভিবাসন নিয়ে বিরোধিতা করলে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না।

কিছুদিনের মাথায় ব্রিটেনে অনেক ইউরোপিয়ান চলে আসেন। ফলে নতুন ইস্যু পেয়ে যায় কনজারভেটিভ পার্টি। ইস্যুটি ভালভাবে কাজেও লাগান তারা। অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেনা তুলে ফেলেন দলটির নেতারা। পরে তাদের দলের নতুন নেতার ভূমিকায় আসেন ডেভিড উইলিয়াম ডোনাল্ড ক্যামেরন। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যও ছিলেন তিনি। অভিবাসন নিয়ে তিনি বরাবরই নেতিবাচক কথা বলে এসেছেন। তাদের সেই কথাগুলো অভিবাসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। ডেভিড ক্যামেরনের দলের দাবি ছিল অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।

আরও দাবি ছিল, কত সংখ্যক অভিবাসী আসা যাওয়া করছে, তার হিসাব রাখা। শুধু তাই নয় এই আসা যাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি কী পরিমাণে হতে পারে তা নিয়েও ভাবেন তারা।

২০১৪ সালে এসে রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া থেকে লোকজনের আসার ওপর সাময়িক নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়া হলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়ে যায়। নতুন একটা রাজনৈতিক দলের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করল এই নতুন ইস্যু। ইউনাইটেড কিংডম ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি (ইউকিপ) লুফে নিল সেই সুযোগ। তারা বহু আগে থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার কথা বলছিল। কিন্তু এতোদিন কেউ তাদের কথা কানেই তোলেনি। কিন্তু এবার তারা জনগণের নজর কাড়তে সক্ষম হন। সেইসঙ্গে ডেভিড ক্যামেরনের দৃষ্টিভঙ্গিও ভাল কাজে দিয়েছে তাদের জন্য।

কিন্তু এবারের ইস্যু ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার বিষয়। বেক্সিট নিয়ে ভোট হল দেশটিতে। পক্ষে রায় দিলেন ৫২ শতাংশ নাগরিক। কনজারভেটিভ পার্টিও থাকলেন অভিবাসন বিরোধীদের কাতারে। কারণ দেশটির বেশিরভাগ নাগরিক মনে করেন বাইরে থেকে আসা লোকেরা তাদের মতো নয়। তারা অনেকটাই অপরাধ প্রবণ, হিংসুটে, সর্বোপরি ব্রিটেনের মানুষদের জন্য ক্ষতিকর।

তাছাড়া দেশটিতে অভিবাসীদের আধিক্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি আগে থেকেই ছিল। কারণ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী ২৮টি দেশের নাগরিকরা ভিসা ছাড়াই এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রবেশ করার অধিকার রাখে।

ডেভিড ক্যামেরন সরকার তার প্রথম মেয়াদে ইইউ`র বাইরের দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও ইইউভুক্ত নাগরিকদের প্রবেশ ঠেকাতে পারেননি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্বিতীয় মেয়াদে ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশ নিরুৎসাহিত করতে চার বছরের জন্য সুবিধা ভাতা বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন ক্যামেরন। কিন্তু প্রবেশ ঠেকাতে কোনো আইন করতে চাননি তিনি। তাতে যদি ইইউ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়!

তারপরও এতে খুশি হতে পারেননি ইইউভুক্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। সদস্য দেশের নাগরিকদের সুবিধা ভাতা প্রদানে বৈষম্য করা হলে তা ইইউর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে দাবি তোলেন তারা। আর এ কারণেই যুক্তরাজ্যকে ইইউতে রাখা না রাখার ব্যাপারে প্রশ্ন তৈরি হয়।

ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইইউভুক্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে অভিবাসীদের সুবিধা সীমিত করাসহ চারটি সংস্কার প্রস্তাব দেন ক্যামেরন এবং পরবর্তীতে সে প্রস্তাব নিয়ে ক্যামেরনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছান ইইউ নেতারা। কিন্তু সেই সমঝোতার মাঝেও দুটি বিষয় টের পাওয়া যায়। এক. ইউউ এর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখা এবং দ্বিতীয়ত, জনগণের কথা চিন্তা করে। এই চিন্তা যে ভোটের তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইইউ’র সঙ্গে সমঝোতার পর দেশে ফিরে ব্রেক্সিটের জন্য গণভোটের তারিখ ঘোষণা করেন ক্যামেরন। ২০১৬ সালের ২৩ জুন গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের ইইউতে থাকা না থাকার প্রশ্নে দেশটির জনগণই ওই গণভোটে চূড়ান্ত রায় দেন।

ইইউতে যুক্তরাজ্যের থাকার বিপক্ষে ৫২ শতাংশ ও পক্ষে ৪৮ শতাংশ ভোট পড়ে। তবে ইইউতে থাকার পক্ষে লন্ডন ও স্কটল্যান্ড শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিল। এই দুই অঞ্চলে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট ইউরোপের পক্ষে। তবে ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে ইইউতে থাকার বিপক্ষে ভোট বেশি পড়েছে। এই গণভোটে ব্যাপক হারে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। এমনকি ব্রিটেনের ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এত ভোট পড়েনি।

গণভোটে ইইউ এর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের রায় পাওয়ার পর একই বছরের ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ডেভিড ক্যামেরন। কারণ হিসেবে জানান, তিনি ব্রেক্সিট সমর্থন করেন না। ক্যামেরনের পদত্যাগের পর যুক্তরাজ্যের ৭৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন থেরেসা মে।

জনগণের চাহিদামাফিক ব্রেক্সিটের পক্ষে যান তিনি। শুধু তাই নয় সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাষ্ট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি তাদের আর আস্থা নেই। তিনি ওই বক্তব্য দিয়েছেন এক সমাবেশে। সেখানে আরও বলেছেন, দেশের মানুষদের নিজেদের ব্যাপারে নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে সময় ব্যাপক হাততালি পেয়েছেন তিনি। তিনি যে হাততালি পাবেন তা আগে থেকেই জানা ছিল।

আবার ব্রেক্সিটের পর সেই থেরেসা মে বলেছিলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসলেও সবার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক চান তিনি। এই রাজনীতি আন্তর্জাতিক।

আর সমাবেশে সেই মন্তব্য যে আসলে ভোটের জন্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যার শুরুটা হয়েছিল পোস্টার ছাপিয়ে বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। সেখানে যেমন ভোটের জন্য ব্রেক্সিটের পক্ষে সুর মেলাচ্ছেন থেরেসা, কোথাও আবার গরু রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন অনেকেই। আবার কোথাও চলছে ভাস্কর্য কাণ্ড। জয় হোক সবখানের ভোটের রাজনীতির।

কেএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।