জঙ্গি হিট লিস্ট : নিরাপত্তাহীনতায় ব্লগাররা


প্রকাশিত: ০২:৪৬ পিএম, ১২ মে ২০১৫

যারা ব্লগে লিখছেন, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করছেন, মুক্তমনায় ও প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী - এমন লোকদের বিশেষ টার্গেটে নিয়েছেন ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। এজন্য আলাদা আলাদা হিটলিস্ট তৈরি করছেন উগ্রবাদীরা। উগ্রপন্থিদের এমন হিটলিস্টে আছেন কমপক্ষে ৮৪ জন। এই ৮৪ জনের মধ্যে শুধু যে ব্লগার রয়েছেন তা নয় রয়েছেন প্রগতিশীল দলের সংগঠক, বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সংগঠক, মুক্তমনা, প্রগতিশীল লেখক ও সাংবাদিক। প্রাথমিক পর্যায়ে জঙ্গিরা হুমকি দিবে তাতে কাজ না হলে চিরতরে সরিয়ে দিবে।

সম্প্রতি উগ্রপন্থিদের নজরদারিতে রয়েছে ফেসবুক স্ট্যাটাস। যারা ফেসবুকে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছেন তাদেরকেও রাখছেন ওই বিশেষ তালিকায়। প্রতিনিয়তই পরিবর্তন-পরিবর্ধন হচ্ছে তালিকাটি। কার আগে কাকে আক্রমণ করা হবে সেই লক্ষ্যও পরিবর্তিত হচ্ছে দিন দিন। এসব ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন ব্লগার, মুক্তমনা লেখক ও সাংবাদিকরা।

গত ফেব্রুয়ারিতে খুন হয়েছেন ব্লগার অভিজিৎ রায়। মার্চে খুন হলেন ওয়াশিকুর রহমান বাবু। সর্বশেষ খুন হলেন সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে খুন হয়েছেন ৯ জন ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, অ্যাক্টিভিস্টদের সমর্থক ও সহযোগী। এর মধ্যে ৮ জন সরাসরি ব্লগিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ব্লগে লেখার সূত্র ধরে উগ্রবাদীদের হিটলিস্টে থাকাদের মধ্যে প্রথমবারের মতো খুনের ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালে। ব্লগার রাজীব হায়দার থাবা বাবা নামের ব্লগে লেখালেখি করতেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে বাসার সামনে নৃশংসভাবে খুন হন তিনি। একই দিন সংঘবদ্ধ আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেন জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট জাফর মুন্সি।

২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় খুন হন ব্লগার মামুন হোসেন। ১ মার্চ খুন হন সিলেটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগজ্জ্যোতি তালুকদার। ৯ এপ্রিল বুয়েটের শহীদ নজরুল ইসলাম হলে হেফাজতে ইসলামের সমর্থক শিক্ষার্থী মেজবাহ উদ্দিনের চাপাতির কোপে আরিফ রায়হান দীপ মারা যান।

৩০ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আমবাগান  ফ্ল্যাটে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করা হয় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও মুক্তচিন্তার সমর্থক আশরাফুল ইসলামকে। ৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের যুগ্ম-সম্পাদক ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবুকে পেছন থেকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে মাথায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায়কে। একই সময় আহত হন আরেক ব্লগার ও অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। ধর্মীয় মতাদর্শগত কারণে গত ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা। হত্যার ঘটনায় আটক দুই যুবক ডিবি পুলিশকে এমন তথ্য দিয়েছেন।

দুই দফায় আঘাতের শিকার হন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে উত্তরায় নিজ কার্যালয়ের সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয় তাকে। একই বছরের ৭ মার্চ রাতে মিরপুরের পূরবী সিনেমা হলের কাছে কুপিয়ে জখম করা হয় ব্লগার সানিউর রহমানকে।

২০১৩ সালের জুনে এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় কোপানো হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাকিব আল মামুনকে। এর বাইরে উগ্রপন্থিদের হাতে বিভিন্ন সময় খুন হয়েছেন আরো অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব। ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পেছন থেকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিটিতেই টার্গেট ছিল মস্তিষ্ক ও মাথা। কারণ উগ্রপন্থিরা মনে করে, মস্তিষ্কই তাদের মূল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। পেছন থেকে কোপানো হয়, যেন চেহারা না দেখা যায়।

অনলাইন ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০১৩ সালে ৮৪ জনের একটি তালিকা দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই তালিকায় থাকা ব্লগার ও নতুন সংযোজিতদেরই হিটলিস্টে রেখেছেন উগ্রপন্থিরা। তবে ব্লগ-সংশ্লিষ্টদের মতে, ওই তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বেশির ভাগ কোনোভাবেই ধর্ম অবমাননার সঙ্গে জড়িত না থাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্লগার ও মুক্তমনা লেখকদের নিরাপত্তার বিষয়টি থেমে গেছে।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও ব্লগার ইমরান এইচ সরকার জানান, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা দিতে উদাসীন। ব্লগারদের হত্যা করছেন ধর্মান্ধরা। হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও তা সম্পর্কে ক্লু দিতে পারছে না পুলিশ। হত্যাকারীরা প্রশ্রয় পেয়ে আরো বেশি শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-পূর্ব) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, উগ্রপন্থিরা নতুন নতুন কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে। তবে গোয়েন্দা পুলিশ উগ্রপন্থিদের দমনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ব্লগার ও মুক্তমনা লেখকদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা হচ্ছে।

জেইউ/এসকেডি/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।