উত্তরের শরণার্থী থেকে দ. কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন
২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পার্ক গিউন হে’র কাছে হেরে যান মুন জ্যা-ইন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন পার্ক। মেয়াদ শেষের আগেই পার্কের বিদায়ে প্রধান সুবিধাভোগী বনে গেলেন দেশটির নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুন জ্যা-ইন।
প্রেসিডেন্টের বাসভবন ব্লু হাউসের লড়াইয়ে মুনের এ বিজয়ের ফলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পুনর্মিলনের একটি যুগের সূচনা হতে পারে। পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক ও ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও নতুন করে বোঝাপড়া তৈরি করতে পারে।
দুই কোরিয়ার তিক্ত বিভাজনে ৬৪ বছর বয়সী উদারপন্থী বাম রাজনীতিক মুন উত্তর এবং দক্ষিণের পুনর্মিলনে নিজেকে একমাত্র যোগ্য প্রার্থী হিসেবে দাবি করেছিলেন। দীর্ঘদিনের বন্ধু চই সুন শিলের সঙ্গে পার্কের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় ওই দাবি করে আসছিলেন।
অভিযুক্ত পার্ক বিচারের অপেক্ষায় কাঠগড়ায় রয়েছেন; অভিযোগ প্রমাণিত হলে দেশটির সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। পার্কের বিচার চলাকালীন দেশটিতে পরির্বতনের আকাঙ্ক্ষা তৈরিতে সক্ষম মুন নির্বাচনে তার নিকটতম মধ্যপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বি আহন চিউল-সু’কে পেছনে ফেলে ডাবল ডিজিট ভোট অতিক্রম করেন।
পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক ও ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জেরে কোরীয় দ্বীপে ক্রমবর্ধমান উত্তজনার মাসে পার্ক ও তার উত্তরসূরী লি মিয়ং-বাকের কঠোর সমালোচনা করেন মুন। দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন এই প্রেসিডেন্ট বলেন, রক্ষণশীল শাসনের এক দশকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে কিছুই করেননি পার্ক।
তবে উত্তর কোরিয়া মুন’কে তাদের অনুকূল প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছিল। সম্প্রতি যার প্রতিফলন দেখা যায়, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে। এতে পার্ক নেতৃত্বাধীন দেশটির রক্ষণশীল সরকারকে পুতুলের সঙ্গে তুলনা করা হয়; একই সঙ্গে এই সরকারকে শাস্তি দিতে দক্ষিণের ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
পাঁচ বছর আগে রক্ষণশীল পার্কের কাছে সামান্য ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর মুন নিজেকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে ভোটারদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি কোরীয় দ্বীপে অতি-সাম্প্রতিক চলমান উত্তেজনায় ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা হঠাৎ বন্ধ করে দেন। ওবামা প্রশাসনের ‘কৌশলগত ধৈর্য’ নীতিকে ব্যর্থ হিসেবে দাবি করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে ঐক্যমত পোষণের ঘোষণা দেন তিনি।
মুনের পররাষ্ট্র রাজনৈতিক উপদেষ্টা বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কাজের আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ না করায় উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এ ধরনের সম্ভাবনা ট্রাম্পের বাগড়ার কারণে বাতিল হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গ্রামে ওয়াশিংটনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের সমালোচনা করেছিলেন মুন। তিনি বলেছিলেন, তিনি যদি নির্বাচিত হন তাহলে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন।
একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণের যৌথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স পুনরায় চালুর পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। ২০১৬ সালের শুরু দিকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে এটিকে আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার একটি প্রতীক হিসেবে মনে করা হতো।
উত্তর কোরিয়া মাত্র এক দশকের মধ্যে ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন আশঙ্কার পর হোয়াইট হাউস দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়ে আসছে। এর মাঝেই মঙ্গলবার দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; সাত মাস আগেই এই ভোট অনুষ্ঠিত হলো। দেশটিতে চরম বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হে’র আমলের রাজনীতিকদের করায়ত্বে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কার আনার অঙ্গীকার করেছেন নতুন প্রেসিডেন্ট।
উত্তর কোরিয়া যুদ্ধের সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় আশ্রয় নেয়া এক শরণার্থী পরিবারের বড় ছেলে মুন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট বনে গেলেন। ১৯৫০ সালে গৃহযুদ্ধের সময় উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় আশ্রয় নেয় মুনের পরিবার। ১৯৫৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় শরণার্থী বাবা-মার ঘরে জন্ম নেন মুন।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ বাহিনীর তরুণ সদস্য হিসেবে ১৯৭৬ সালে বেসামরিক একটি এলাকার মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার শেষের পর দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু-হিউনের চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আধুনিক দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে শরণার্থী থেকে প্রেসিডেন্টের আসনে যাওয়া মুন দেশটিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দ্য গার্ডিয়ান ও নিউজ উইক অবলম্বনে সাইফুজ্জামান সুমন।
এসআইএস/এমএস