মোবাইল সেট আমদানিতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
মোবাইল ফোন আমদানিতে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। চালানপত্রে পণ্যের দাম কম দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজসে গত কয়েকবছর ধরে এটি চলছে। এভাবে প্রতি বছর সরকার ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে।
অপরদিকে, অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক সৎ ব্যবসায়ী নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আবার যারা ব্যবসা করছেন তাদের অনেকেরই বেহালদশা। মোবাইল সেট আমদানির সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, দেশের বাজারে সাড়ে ৮ হাজার টাকা দামে বিক্রি হওয়া একটি স্মার্টফোনের শুল্কায়ন যোগ্যমূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৬ ডলার! যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। এর সঙ্গে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে নির্ধারিত পরিমাণের চাইতে অধিক পরিমাণ সেট আমদানি তো রয়েছেই।
সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছর মোবাইল সেটের শুল্ক কর বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে ১ শতাংশ তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করা হয়। অপরদিকে গত অর্থবছরে শুল্ক কর ছিল ১০ শতাংশ। শুল্ক বাড়ানোর ফলে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অসাধু আমদানিকারকরা মোবাইলসেট আমদানিতে আন্ডারইনভয়েসিং করছেন।
সংশ্লিষ্ট নিভর্রযোগ্য সূত্র মতে, দেশের বার্ষিক মোবাইল বাজারের মোট মূল্য প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে উক্ত অসাধু ব্যবসার আকার ১০ শতাংশ হলেও তা দাঁড়ায় ৫৫০ কোটি টাকায়। আর তাতে ধারণা করা যায় প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মত রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, যা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকির ফলে ক্ষতিগ্রস্থ মূলত হচ্ছে সরকার ও সৎ আমদানিকারকরা।
দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চীন থেকে আমদানি করা প্রতিটি হ্যান্ডসেট আনার সময় শুল্ক বিভাগকে মূল্য অবহিত করতে হয়। শুল্ক বিভাগ তা বিবেচনা করে তাদের নিজেদের অ্যাসেসমেন্ট অনুযায়ী এর মূল্য পুনঃনির্ধারণ করতে পারে। শুল্ক আরোপ তখনই নির্ধারণ করা হয়। আর এরপর তা দেশের বাজারে মূল্য নির্ধারণ করার সময় মোবাইল কোম্পানি, ব্র্যান্ডভেদে তা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ মার্জিন রেখে বাজারে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু যখন কোনও আমদানিকারক দেশের বাজারে ২০০ থেকে ১০০০ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন রেখে মোবাইল ফোন বাজারে ছাড়ে, তখনই এই আন্ডারইনভয়েসিং প্রতিয়মান হয় এবং সরকারকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
কর ফাঁকির হিসাব পরিসংখ্যান করে দেখা গেছে, প্রতি হ্যান্ড সেটে সর্বনিম্ন ৩০৭ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৭০৩ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। যা সারা বছরে এসব কোম্পানির লাখ লাখ মোবাইল সেট আমদানি বিবেচনায় আনলে তার পরিমাণ শিউরে উঠার মতো।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতো কম দামে স্মার্টফোন আমদানি সম্ভব নয়। যেখানে বার (সাধারণ) ফোনের সর্বনিম্ন আমদানি মূল্য হচ্ছে ৫ থেকে ৭ ডলার। তাদের মতে, ১৫ থেকে ২০ ডলারের নিচে স্মার্টফোন আমদানি সম্ভব নয়। এখানে আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণা দিতে পারেন। আবার এতো কমসংখ্যক মোবাইল সেট কোন রপ্তানিকারকই রপ্তানি করবেন না বলে তাদের দাবি।
ব্যবসায়ীদের মতে, অনেক মোবাইল সেট ব্যবসায়ী যেসব ফোন আমদানি করছেন তাতে যে ধরনের ফিচার থাকার কথা অনেক ক্ষেত্রে সে সব ফিচার থাকছে না। ক্রেতাদের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে এসব নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করছেন তারা। এতে ক্রেতারা ঠকছেন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা দায়ী। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবে বাজারে নিম্নমানের মোবাইল সেট সয়লাব হয়ে গেছে। ফলে সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে নিম্নমানের মোবাইল সেট আমদানিতে তারা উৎসাহিত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল সেটের ধরণ ভেদে আলাদা আলাদা এইচএস কোড ও ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণ করে দিলে শুল্ক ফাঁকি কিছুটা হলেও কমবে। অর্থাৎ বার ফোন, স্মার্টফোন, ট্যাবের জন্য পৃথক এইচএস কোড ও শুল্কহার করা যেতে পারে। এছাড়া সেট ভেদে ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণ করলেও শুল্ক ফাঁকি কমবে।
অপরদিকে মোবাইল সেট আমদানিতে বিটিআরসিতে আইএমইআইনম্বর দাখিল করা বাধ্যতামূলক হলেও এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না বলে সূত্রে জানা যায়।
এসএ/আরএস/আরআই