নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন

খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৩৬ পিএম, ১৩ মার্চ ২০২৫
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ব্যাংক রেজোলিউশন অ্যাক্ট কার্যকর করার পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এছাড়া, আগামী এপ্রিল থেকে খেলাপি ঋণকে অননুমোদিত ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন, এনপিএল) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করার সময়সীমা বর্তমান ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাসে আনা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মানদণ্ড বেসেল- ৩ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ব্যাসেল- ৩ হলো ব্যাংকগুলির জন্য একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক কাঠামো যা ব্যাসেল কমিটি অন ব্যাংকিং সুপারভিশন (বিসিবিএস) দ্বারা তৈরি। বিশেষ করে ২০০৭-২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার জন্য এই মানদণ্ড প্রণয়ন করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। এই কর্মসূচির শর্তানুযায়ী, ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করতে এবং দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে হবে।

গত বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এনপিএল শ্রেণিবদ্ধ করার সময়সীমা নয় মাস থেকে কমিয়ে ছয় মাস করেছিল, যার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা (২৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৮৪০ ডলার), যা সেপ্টেম্বরের ২ দশমিক ৮৪ ট্রিলিয়ন টাকার তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। এটি বাংলাদেশের মোট বকেয়া ঋণ ১৭ দশমিক ১১ ট্রিলিয়ন টাকার প্রায় ২০ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ঢাকার ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে. মুজেরি দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থাকে ‘ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাত এখন খাদের কিনারায়। সরকারের উচিত ছিল অনেক আগেই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া, যেমন দুর্বল কিছু ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া, যাদের টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মুজেরি আরও বলেন, সরকারকে প্রথমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা সংগ্রামরত ব্যাংকগুলোর অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায় নাকি সেগুলো অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত করতে চায়। তিনি বলেন, এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া। আমার মনে হয় আমরা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছি এবং অনেক সময় নষ্ট করছি। ফলে ব্যাংকিং খাত আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর সম্প্রতি বলেছেন, এপ্রিলে মানদণ্ড কঠোর হওয়ার পর আগামী কোয়ার্টারে এনপিএল দ্রুত বাড়তে দেখা যাবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অতীতে বড় ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের সাহায্য করতে বিভিন্নভাবে খেলাপি ঋণ গোপন করা হতো। এখন সেই ‘খারাপ প্রথা’ বন্ধ হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, নতুন মানদণ্ড চালু হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ হতে পারে। গত জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যাগ্রস্ত সম্পদের মোট মূল্য ছিল ৬ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন টাকা।

গত বছর, কিছু ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটায় সেগুলোকে একীভূত করার পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশ কয়েকটি সংগ্রামরত ব্যাংক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হওয়ার চুক্তি করেছিল। তবে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর এই উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

কর্তৃপক্ষ বলছে, আগের সরকারের রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীরা কিছু ব্যাংক লুটপাট করেছেন। বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্ব এখন ব্যাংকগুলোর জন্য সহায়তা দিচ্ছে, তবে কর্তৃপক্ষ মনে করে যে সংগ্রামরত ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার জন্য একীভূত হওয়া প্রয়োজন।

একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সহজ করতে ঢাকা ব্যাংক রেজোলিউশন অ্যাক্ট প্রস্তুত করছে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ নামে পরিচিত। এই আইনে একীভূতকরণ, পুনঃপূজায়ন, ব্রিজ ব্যাংক, অস্থায়ী মালিকানা এবং ব্যাংক বন্ধ করার মতো বিধান থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মনসুর বলেন, আমরা দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের চেষ্টা করব, তাদের জন্য নতুন বিনিয়োগকারী আনব এবং তাদের পুনর্গঠন করব। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশে এখনও ব্যাংক বন্ধ করার জন্য কোনো আইন নেই। মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছয়টি ব্যাংকের সম্পদ গুণগত মান পর্যালোচনা করছে এবং শীঘ্রই অন্যান্য ব্যাংকের জন্য একই প্রক্রিয়া শুরু করবে। এরপর আমরা ব্যাংক রেজোলিউশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনের পদক্ষেপ নেব।

বিজ্ঞাপন

এই আইনের উদ্দেশ্য হলো আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, পেমেন্ট, ক্লিয়ারিং ও সেটেলমেন্ট সিস্টেমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, ব্যাংক জমা সুরক্ষিত করা, সরকারি আর্থিক সহায়তা কমিয়ে সরকারি তহবিল সংরক্ষণ করা, সম্পদের মূল্য ধ্বংস এড়ানো ও ঋণদাতাদের ক্ষতি কমানো। এছাড়া, আর্থিক ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা বজায় রাখাও এই আইনের লক্ষ্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে বকেয়া থাকা ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করত। তবে, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে এবং কোভিড-১৯ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব কমাতে এই নিয়ম শিথিল করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আবারও এই নিয়ম কঠোর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, এনপিএল শ্রেণিবদ্ধ করার সময়সীমা কমালে সমস্যাগ্রস্ত সম্পদ দ্রুত চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে এবং ব্যাংকগুলো সেগুলো কঠোরভাবে তদারকি করবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। যেসব ব্যাংক এই পরিবর্তনগুলো কার্যকরভাবে মোকাবিলা করবে এবং শক্তিশালী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ঋণ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে, তাদের কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

বিজ্ঞাপন

এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে আরও সুসংহত ও স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সূত্র: নিক্কেই এশিয়া

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।