দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
ভারতের অর্থনীতি চাঙা করতে মোদীর সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চলতি মাসের ১ তারিখে বাজেট ঘোষণার আগে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের কল্যাণের জন্য হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। অথচ বাজেট ঘোষণার পর দেখা যায়, এর আসল সুবিধাভোগী হয়েছে শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আবার ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ১ ট্রিলিয়ন রুপি (প্রায় ১ হাজার ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) মূল্যের কর ছাড় ঘোষণা করেন, যা অনেক উচ্চ আয়ের ভারতীয়কে সম্পূর্ণভাবে আয়কর থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
ভারত সরকারের দাবি, দেশটির অর্থনীতি চাঙা করতে এই নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, যেখানে ২০২৩ সালে ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ। সরকারি অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে, যা মহামারির পরবর্তী সময়ের তুলনায় কম। ভারত সরকার ২০৪৭ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যার জন্য অন্তত ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা প্রয়োজন।
প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সাময়িক ধীরগতি পার করছে ভারতের অর্থনীতি। করোনা মহামারির পর দেশটির মধ্যবিত্তরা সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেছিল, যার ফলে প্রবৃদ্ধি দ্রুত হয়েছিল। কিন্তু পরে কঠোর নীতি গ্রহণ করা হয়।
২০২৩ সালের শেষদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (আরবিআই) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত ঋণ প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এরপর থেকেই মূলত দেশটির অর্থনীতিতে ধীরগতি আসে। ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ রুপির মূল্য ডলারের বিপরীতে সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
বর্তমানে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে নতুন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে মোদী সরকার। জানুয়ারির ২৭ তারিখ আরবিআই ব্যাংকিং খাতের তারল্য বাড়াতে কিছু নীতি গ্রহণ করে, যার মধ্যে ছিল বন্ড কেনা ও পুনঃক্রয় নীতি। ব্যাংকটির নতুন গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা ডলারের বিপরীতে রুপির মান কমিয়ে দেওয়ার নীতিতে কম হস্তক্ষেপ করবেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যয় ক্ষমতা বাড়াতে কর ছাড় দিয়েছে ভারত। নতুন কর কাঠামোতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার বেতনভোগী কর্মীদের বাৎসরিক ১২ লাখ ৭৫ হাজার রুপি আয় পর্যন্ত কোনো কর না দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
নতুন বাজেটে কর ছাড়ের আওতায় থাকবেন ভারতের উচ্চ আয়ের কর্মীরাও। বছরে ৫০ লাখ রুপি যাদের আয়, নতুন কাঠামোয় তারা ছাড় পাবেন ১ লাখ ১০ হাজার রুপি।
তবে চ্যালেঞ্জের মুখে তখনই পড়তে হয়, যখন ভারতের ৫৮ কোটি ৯০ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে মাত্র ৭ কোটি ৬০ লাখ কর্মজীবী কর রিটার্ন দাখিল করে। বেশিরভাগ ভারতীয়কে কর দিতে হয় না, কারণ ৪৩ শতাংশ জনগণ কৃষি খাতে কাজ করে। আর দেশটিতে কৃষি থেকে প্রাপ্ত আয় করমুক্ত। আর সে কারণেই সরকার আশা করছে, চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের হাতে বেশি অর্থ থাকলে তা নিম্নবিত্তদের উপকারে আসবে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো
কর্মসংস্থান ও শিল্পখাত
ইকোনমিস্ট বলছে, ভারতের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য শুধু মধ্যবিত্তের আয় বাড়ানো যথেষ্ট নয়, চাহিদা ও কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি। চিকিৎসা, পর্যটনসহ ভারতের বিভিন্ন ধরনের সেবাখাত দেশটির বৈদেশিক আয়ের বড় উৎস হলেও এটি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ।
ভারতের মোট জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ আসে উৎপাদন শিল্প থেকে, যা ১৯৬৭ সালের পর সর্বনিম্ন। দেশটিতে বেসরকারি বিনিয়োগও দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল, ফলে রেল, বন্দর ও সেতুর মতো সরকারি প্রকল্পই প্রধান বিনিয়োগের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের সরকারি বেকারত্ব হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ হলেও বহু মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে স্বল্প মজুরির চাকরিতে কাজ করছেন।
বিশ্ববাজার ও ভারতের নতুন কৌশল
ভারত যদি চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত দেশ হতে চায়, তবে অপেক্ষাকৃত সস্তা উৎপাদন শিল্পের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অর্থনীতির মডেল অনুসরণ করতে হবে। তবে বর্তমান বিশ্বে বাণিজ্য প্রতিরোধমূলক নীতি ও শুল্ক বেড়েছে, যা ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নির্মলা সীতারামন বাজেটে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন, যার মধ্যে ভোক্তাপর্যায়ের ইলেকট্রনিকস, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও শিল্প যন্ত্রপাতি রয়েছে।
হার্লে-ডেভিডসন মোটরসাইকেলের শুল্কও কমানো হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি ছিল।
নিয়মনীতি শিথিলকরণের প্রয়োজনীয়তা
ভারতের শিল্পখাতের বিকাশে সরকারি বিধিনিষেধ শিথিল করা জরুরি। বাজেটে একটি উচ্চপর্যায়ের প্যানেল গঠন করা হয়েছে, যা ব্যবসার অনুমতি পেতে সহজ করবে।
ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলে দেরি হলে শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা আগে কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ ছিল। তবে শ্রম আইন ও ভূমি নীতির ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি, যা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।
ইকোনমিস্ট বলছে, ভারত যদি তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে ও ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে হলে আরও সাহসী সংস্কার করতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে রপ্তানি প্রতিযোগিতাও। যদিও সম্প্রতি ভারত সরকার কিছু জনপ্রিয় নীতি হাতে নিয়েছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া ভারতের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন সম্ভব নয়।
এখন, সরকারি নীতির পরিবর্তন ভারতের অর্থনীতিকে কতটা চাঙা করতে পারে, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায়, ভারতের উন্নয়নের জন্য শুধু সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, বরং হয়ত ‘দেবীর আরও আশীর্বাদ’ প্রয়োজন।
এসএএইচ