দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
আমেরিকায় অ্যাভিয়ান ফ্লুর বিস্তারে খাদ্যবাজারে অস্থিরতা, চাপে ট্রাম্প প্রশাসন

যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাভিয়ান ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশটির অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে। ডিমের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে, তার সঙ্গে বাড়ছে রাজনৈতিক বিতর্কও।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট চেইন ওয়াফল হাউস ঘোষণা দেয়, তারা প্রতি ডিমের জন্য ৫০ সেন্ট অতিরিক্ত চার্জ নেবে। অ্যাভিয়ান ফ্লুর কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় এক ডজন ডিমের দাম সাত ডলার ছাড়িয়েছে। গত এক বছরে এর দাম বেড়েছে প্রায় ১৪০ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতেও সুপারমার্কেটগুলোতে ডিমের সংকট দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন>>
- আমেরিকায় ডিমের আকাল, ট্রাক থেকে খোয়া গেলো এক লাখ পিস
- বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধের শঙ্কা বাড়াচ্ছে ট্রাম্পের কঠোর শুল্কনীতি
- আমেরিকার পেমেন্ট সিস্টেমে অস্থিরতা: মাস্কের হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম টার্কির মধ্যে ধরা পড়ে অ্যাভিয়ান ফ্লুর সংক্রমণ। এরপর থেকে এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এখন পর্যন্ত ১৫ কোটির বেশি পাখির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতেই মারা গেছে ৪ কোটি ১০ লাখের বেশি পাখি। এরপর ভাইরাসটি গরুর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে এ পর্যন্ত অন্তত ৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই দুগ্ধ খামারের শ্রমিক। গত জানুয়ারিতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যুও হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত মানুষের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই এটি মানবজাতির জন্য তাৎক্ষণিক বড় কোনো হুমকি নয়। তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠেছে।
মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) এরই মধ্যে এই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে ২০০ কোটি ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। কিন্তু ভোক্তাদের জন্য খরচ আরও বেশি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ডিমের মূল্যবৃদ্ধি রাজনৈতিক বিতর্কেরও কেন্দ্রে রয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জেডি ভ্যান্স বলেছিলেন, কমলা হ্যারিসের মূল্যস্ফীতিমূলক নীতির কারণে ডিমের দাম বেড়েছে।
সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা
অ্যাভিয়ান ফ্লু প্রতিরোধে অনেক দেশ পাখিদের টিকা দিয়েছে, যার মধ্যে মেক্সিকো অন্যতম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টিকা থাকলেও তা ব্যবহার করা হয়নি। কারণ, টিকা দেওয়া মুরগির রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। অনেক দেশ এমন টিকা দেওয়া পাখি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। কারণ সংক্রমিত হলেও এসব পাখির মধ্যে উপসর্গ না-ও দেখা যেতে পারে।
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ থমাস মার্শ বলেন, এই রোগ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকর কৃষিখাত রক্ষা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে হয়।
অ্যাভিয়ান ফ্লু মুরগির জন্য মারাত্মক হলেও গরু সাধারণত এই ভাইরাস থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে এতে ভাইরাসের মিউটেশন হয়ে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ফলে সংক্রমণ পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে টেক্সাসে গরুর মধ্যে এই ভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলেও, পর্যাপ্ত পরীক্ষা করা হয়নি। ২০২৪ সালের মার্চে গরুর মধ্যে অ্যাভিয়ান ফ্লুর প্রাদুর্ভাব আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ততদিনে রোগ সাতটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ
এখন এই সংকট মোকাবিলার দায়িত্ব ট্রাম্প প্রশাসনের কাঁধে। সম্প্রতি নেভাডার পশুসম্পদে অ্যাভিয়ান ফ্লুর নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের পর কৃষিনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন না এলেও মহামারি সংক্রান্ত নীতিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় এসেই সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ সীমিত করে দেয়। এর ফলে সংক্রমণ পর্যবেক্ষণের কাজ ব্যাহত হয়েছে।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির প্যান্ডেমিক সেন্টারের পরিচালক জেনিফার নুজ্জো বলেন, এটি একটা ভয়ানক পরিস্থিতি। এখন আমাদের আরও দ্রুত তথ্য দরকার, দেরিতে নয়।
বর্তমান ডিমের চড়া দামের বিষয়ে প্রশাসনের তেমন কিছু করার সুযোগ নেই। বরং ইউএসডিএ আশঙ্কা করছে, দাম আরও বাড়বে। সাধারণত অ্যাভিয়ান ফ্লু আক্রান্ত খামারের মুরগি মেরে ফেলতে হয়, তারপর খামার পরিষ্কার করা হয় এবং নতুন মুরগি বড় করতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগে।
তবে গরুর সংক্রমণ ও মানুষের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ কিথ পলসেন বলেন, আমার মতে, প্রত্যেক দুগ্ধ খামার ও দুগ্ধ প্রসেসিং কারখানায় মাসে অন্তত একবার পরীক্ষা চালানো উচিত।
তবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, খামার শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই অনথিভুক্ত অভিবাসী, যারা সরকারি পরীক্ষা এড়িয়ে চলতে পারেন। বিশেষ করে, ট্রাম্প প্রশাসন যখন হাসপাতালগুলোতেও অভিবাসীবিরোধী অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে, তখন এসব শ্রমিক পরীক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে চাইবেন না। ফলে মানুষের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
কেএএ/