অর্থনীতি

দুয়ার সার্ভিসেস’র কিউআইও স্থগিত করলো বিএসইসি

দুয়ার সার্ভিসেস’র কিউআইও স্থগিত করলো বিএসইসি

বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর শেয়ারবাজার থেকে দুয়ার সার্ভিসেস এর অর্থ উত্তোলনে কোয়ালিফায়েড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) আবেদন স্থগিত করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

Advertisement

আগামী ১৯ জানুয়ারি থেকে কোম্পানিটির কিউআইও আবেদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। আবেদন শুরু হওয়ার পাঁচদিন আগে কোম্পানিটির কিউআইও আবেদন স্থগিত করে বিএসইসি ও ডিএসই’র কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।

মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) বিএসইসির ৯৩৯তম কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভা শেষে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

এর আগে গত ৯ জুন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৯১১তম কমিশন সভায় কোম্পানিটির কিউআইও অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর গত ৫ ডিসেম্বর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন লিখিতভাবে সম্মতিপত্র (কনসেন্ট লেটার) দেয়।

Advertisement

কিউআইও প্রদানের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, কোম্পানিটির ২০২২-২৩ অর্থবছরে শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) দেখানো হয়েছে ৪.৮৬ টাকা। আর নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৭.৮৫ টাকায়।

তবে সম্প্রতি কোম্পানিটির সেবা প্রদান সংক্রান্ত চুক্তি, মুনাফা ও আয় নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, যা কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এর আলোকে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি, যা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এসএমই খাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দুয়ার সার্ভিসেস পিএলসিকেও ৫ কোটি টাকার কিউআইও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দুয়ার সার্ভিসেস প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের ৫০ লাখ শেয়ার যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাছে ইস্যু করে বাজার থেকে ৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। উত্তোলিত অর্থ দিয়ে কোম্পানিটি প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট (দুয়ার স্কুল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার, ডি-কুরিয়ার, কল সেন্টার ও ট্র্যাকিং সিস্টেম ও এআই সফটওয়্যার), ক্লাউড কম্পিউটিং ও আনুষঙ্গিক খরচসহ ইস্যু ব্যবস্থাপনার খরচ খাতে ব্যয় করবে বলে জানায়।

আরও পড়ুন

Advertisement

শেয়ারবাজার থেকে ৫ কোটি টাকা নেবে ‘দুয়ার সার্ভিসেস পিএলসি’ শেয়ারবাজারে থামছে না দরপতন, বিনিয়োগকারীদের হতাশা বাড়ছে

এদিকে কোম্পানির প্রসপেক্টাসের তথ্য অনুসারে ‘দুয়ার সার্ভিসেস’ মূলত এজেন্ট ব্যাংকিং, সফটওয়্যার সেবা এবং ডিজিটাল সার্ভিসের কাজ করে। কোম্পানি আগে গঠন হলেও ২০১৯ সাল থেকে মূল কাজ শুরু হয়। শুরুতে এর মূলধন ছিল মাত্র ১০ লাখ টাকা। এরপর ২০২২ সালে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়ে এক লাভে কোম্পানিটি পরিশোধিত মূলধন ৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা করে।

এভাবে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর পাশাপাশি কোম্পানিটির আয় এবং মুনাফাও রহস্যাবৃত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানির মোট আয় ৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মুনাফা ২১ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় ৭১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বিপরীতে মুনাফা ২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আবার ২০২১ সালে আয় ৪২ কোটি ৭৪ লাখ। এর বিপরীতেও মুনাফা ২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আয় যতই বাড়ুক, মুনাফা কাছাকাছি রয়েছে।

সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে গ্রাহক সংখ্যা মাত্র ৩টি। তবে মূল গ্রাহক সংখ্যা ২টি। এর মধ্যে রয়েছে- অগ্রণী ব্যাংক এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। মোট আয়ের ৯৯ শতাংশই এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। বাকি ১ শতাংশেরও কম আয় এসেছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা আয়ের মধ্যে শুধু অগ্রণী ব্যাংকের কাছ থেকে এসেছে ৬৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা কোম্পানির মোট আয়ের ৮২ শতাংশ শতাংশ। এছাড়া আইডিআরএ থেকে এসেছে ১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বা ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ এবং এমআরএ ১১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বা দশমিক ৯০ শতাংশ।

দুয়ারের সেবাগ্রহণ ইস্যুতে অগ্রণী ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি এই ব্যাংকটি এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন অভিযোগ তুলে বলেছে, ব্যাংকটি নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন সফটওয়্যার ব্যবহারের পরিবর্তে তৃতীয় পক্ষের সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, ২০২৩ সালে প্রতি মাসে দুয়ার সার্ভিসেসকে শুধু একটি সেবার বিপরীতেই ১ কোটি ১ লাখ টাকা করে দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, যা অর্থের অপচয়। এরপর কয়েক মাস পাওনা পরিশোধ বন্ধ করে দেয় অগ্রণী ব্যাংক।

দুয়ার সার্ভিসের কার্যক্রম আইডিআরএ এবং বিমা খাতেও প্রশ্নবিদ্ধ। বিমা খাতের অংশীজনদের ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০২০ সালে জঙ্গিবাদের দোহাই নিয়ে বিমা কোম্পানিগুলো এই প্রতিষ্ঠানটির সেবা নিতে বাধ্য করে আইডিআরএ। তবে সরকারের পটপরিবর্তন হওয়ার পর দুয়ার সার্ভিসেসকে অর্থ দেওয়া বন্ধ রেখেছে বিমা কোম্পানিগুলো।

বিমা কোম্পানির গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থ লেনদেনসহ একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভান্ডার তৈরির জন্য ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলামকে চিঠি দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছেও পাঠানো হয় সেই চিঠির অনুলিপি।

ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর জঙ্গি তৎপরতায় সম্ভাব্য আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি ও স্বচ্ছতা আনার কথা উল্লেখ করে ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলায় অনেক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এসব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যে আর্থিক লেনদেন করে তার কোনো স্বয়ংক্রিয় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। কোথায়, কে, কীভাবে এসব অর্থ ব্যয় করছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান এবং হিসাব সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই।

এতে বলা হয়, স্বচ্ছতা ও কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় একদিকে যেমন সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি এই অর্থ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এসব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অর্থ প্রবাহের তথ্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের মাধ্যমে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে এবং জঙ্গি তৎপরতা দমনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইউনিফাইড মেসেস প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু ইন্স্যুরেন্স সেক্টরের কতিপয় অসাধু চক্রের কারণে তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এর আলোকে সব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে একটি স্বয়ংক্রিয় কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের অধীনে আনার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

তখন আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ছিলেন শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, যিনি একসময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন। তার বিশেষ আগ্রহে এরপর ইউনিফায়েড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম বা ইউএমপি নামের একটি উদ্যোগ দাঁড় করানো হয়। আর কোনো ধরনের উন্মুক্ত দরপত্র না ডেকেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বেছে নেওয়া হয় দুয়ার সার্ভিসেসকে।

প্রথমে দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড প্রিমিয়াম প্রতি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ১০ টাকা করে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তা দর-কষাকষি করে পরে ৮ টাকায় নামিয়ে আনে আইডিআরএ। পরে তা আরও কমিয়ে ৩ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এর বাইরে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাচাই করার জন্যও ১ টাকা করে পাচ্ছে দুয়ার সার্ভিস।

অবশ্য বিমা কোম্পানিগুলো শুরু থেকেই ইউএমপি’র বিরোধিতা করছে। কিন্তু বিমা কোম্পানিগুলোর বিরোধিতা আমলে না নিয়েই আইডিআরএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী ইউএমপি চালু করতে ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠি দেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। মুস্তফা কামালও তাতে অনুমোদন দেন। অনুমোদনের আগেই এটি চালু হয়। তবে ২০২০ সালের শুরুর দিকেই পুরোদমে চালু হয়ে যায় ইউএমপি।

একটি বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, দুয়ার সার্ভিসেস যে এসএমএস’র জন্য ৩ টাকা ৯০ পয়সা করে নিচ্ছে, আমরা নিজ উদ্যোগে যে কোনো মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ৫০ পয়সার কমে সেই এসএমএস পাঠাতে পারতাম। কিন্তু কোনো প্রকার দরপত্র ছাড়াই কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে দুয়ার সার্ভিসেসকে এই কাজ দেয় আইডিআরএ। এর ফলে বিমা খাতের মোটা অঙ্কের টাকা ওই প্রতিষ্ঠানটির পকেটে চলে গেছে। সেই সঙ্গে গ্রাহকদের তথ্যও ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে।

এমএএস/ইএ