নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের দুই শতাধিক নেতাকর্মী এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষায় বসতে পারেননি। মাথায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার খড়্গ নিয়ে ক্লাস কিংবা অন্য যে কোনো ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকেও তারা দূরে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্মতি থাকলেও সহপাঠীরা বয়কট করায় ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না তারা।
Advertisement
হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে একটি কমিটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে পাঁচ মাসেও কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।
ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, হামলায় জড়িতদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত দিক। তারা জড়িতদের সঙ্গে কোনো ক্লাস-পরীক্ষায় বসতে চান না।
আমরা এখন অভিযোগকারী সবার সঙ্গে কথা বলছি। এদের মধ্যে অনেকে ভয়ে সরাসরি আসতে চাইছে না, তাদের সঙ্গে আমরা জুমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। সবার কথা শুনে এ মাসেই আমরা প্রতিবেদন দেবো।- তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক কাজী মাহফুজুল হক সুপন
Advertisement
আর ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, অপরাধ করলে তাদের শাস্তি দেওয়া হোক, এভাবে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখা কোনো সমাধান নয়। সবমিলিয়ে শিক্ষাজীবন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় হামলায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক-নেতাকর্মী-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা না দিতে দেওয়ার এমন সংস্কৃতি এর আগে ছিল না। রাজনৈতিক কোনো সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রে সেই শিক্ষার্থী হলে থাকতে পারতেন না, তবে বাইরে থেকে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতেন। দু-একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি দলের অথবা হলের দখলে থাকা ছাত্র সংগঠন বাধার সৃষ্টি করতো না। এমনকি জেলখানায় থাকা অবস্থায়ও অনেকের পরীক্ষা নেওয়ার উদাহরণ আছে। তবে এবারই প্রথম সম্মিলিতভাবে এত শিক্ষার্থী একসঙ্গে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না।
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যা বলছেনএকটি হামলায় অংশ নেওয়ার কারণে বিচারের আওতায় না এনে এভাবে একাডেমিকভাবে হেনস্তা করা উচিত নয় বলে দাবি করেছেন পরীক্ষা দিতে না পারা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা বলেন, তাদের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো সিদ্ধান্তই নিচ্ছে না। তাদের কোনো শাস্তিও দিচ্ছে না, ক্লাস-পরীক্ষাও দিতে দিচ্ছে না। তারা অন্যায় করে থাকলে শাস্তি দিক, কিন্তু কোনো শাস্তি ছাড়াই সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখা তো অন্যায়।
হামলাকারীরা ক্লাসে না ফিরতে পারার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক তার নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজের ভেতরের ভয় এবং সহপাঠীদের পক্ষ থেকে বয়কট। সহপাঠীদের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে বাধা আসাটা খুবই যৌক্তিক।- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের
Advertisement
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে একটি কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটি ইতোমধ্যে হামলায় আহত শিক্ষার্থীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে এবং হামলার সময়কার ভিডিও ফুটেজ, ছবি বিশ্লেষণে কাজ করছে। পাঁচ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি কমিটি। চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটিও জানায়নি কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আরও পড়ুন শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কায় ছাত্রলীগ, প্রশাসনের অবস্থান ‘অস্পষ্ট’ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়নি ক্লাস, ফের ফিরছে সেশনজট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার নৃশংসতা, ‘জনতার বিচার’ থামবে কবে? পরীক্ষা দিতে এসে তোপের মুখে ছাত্রলীগ নেতা, থানায় সোপর্দএ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও স্যার এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ কাজী মাহফুজুল হক সুপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এখন অভিযোগকারী সবার সঙ্গে কথা বলছি। এদের মধ্যে অনেকে ভয়ে সরাসরি আসতে চাইছে না, তাদের সঙ্গে আমরা জুমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। সবার কথা শুনে এ মাসেই প্রতিবেদন দেবো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে নিরুৎসাহিত করছে না। পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে যখন যে ধরনের সহযোগিতা চায় আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে চেষ্টা করি।- উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে আহ্বায়ক বলেন, ‘কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটা নির্ধারণ করা আমাদের কাজ নয়। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করবো। আমরা চাই না নিরপরাধ কেউ শাস্তি পাক, আবার এটাও চাই না যে অপরাধীরা কেউ পার পেয়ে যাক।’
যা বলছেন ছাত্র নেতারাএ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর নারকীয় হামলা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যে বর্বরোচিত কায়দায় হামলা চালানো হয়েছে এবং সেগুলার স্পষ্ট ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাঁচ মাসেও কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি।’
‘হামলাকারীরা ক্লাসে না ফিরতে পারার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক তার নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজের ভেতরের ভয় এবং সহপাঠীদের পক্ষ থেকে বয়কট। সহপাঠীদের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে বাধা আসাটা খুবই যৌক্তিক। কারণ লীগের এই সন্ত্রাসীরাই আন্দোলনের সময় তার সহপাঠীদের ওপর সরাসরি হামলা, হুমকি-ধমকি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়েছে। সঙ্গত কারণেই সহপাঠীরা তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করেছে, আর অভিযুক্ত ব্যক্তিও নিজের ভেতরকার ভয়ের জায়গা থেকে একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে না।’
আব্দুল কাদের আরও বলেন, ‘আর আওয়ামী আমলে ভিন্ন মতাবলম্বী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সঙ্গে যদি এখনকার পরিস্থিতি তুলনা করেন তাহলে ভুল হবে। দুই পরিস্থিতি কখনোই এক নয়। ছাত্রলীগ শুধু প্রতিহিংসার কারণে ভিন্ন মতাবলম্বীকে একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে জোরপূর্বক বাধা দিতো। এখন যারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তারা তো গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, কেউ আবার সরাসরি খুনি। খুনি ও খুনির দোসরদের সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না। প্রশাসন যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিক, এটাই আমাদের দাবি।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অপরাধে অভিযুক্ত সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিলেই এ সমস্যা কেটে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা শুনছি বেশ অনেকদিন ধরেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কমিটি/কমিশন অপরাধীর তালিকা এখনো প্রকাশ করেনি।’
তিনি বলেন, ‘তালিকা প্রকাশ ও শাস্তির আওতায় আনা নিশ্চিত হলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিক থেকে গণহারে ট্যাগিং পলিটিক্স কিংবা সম্ভাব্য সব ধরনের মব কালচার থেমে যাবে। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মূলত ছাত্রলীগ ও তাদের ভীতিকর কার্যক্রম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের ধীরগতির কাজ।’
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আরমানুল হক বলেন, ‘যারা হামলায় জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনা প্রথমত প্রশাসনের জরুরি বিষয় ছিল। কারণ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেই ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি, এটা প্রশাসনের সমালোচনার জায়গা। আবার তাদের কোনো ধরনের বিচারের আওতায় না এনে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে না দেওয়া, সেটা যে কারণেই হোক, সেটাও সমালোচনার জায়গা। যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল অফেন্স আছে তাদের জরুরিভিত্তিতে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।’
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মুজাম্মেল হক বলেন, ‘১৫ জুলাইসহ বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত ও নির্দেশদাতা ছাত্র-শিক্ষকদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার। প্রশাসনের পক্ষে উদ্যোগ না নিলে শিক্ষার্থীদের দিক থেকে মব তৈরি করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লাঞ্ছিত করা, ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ না নিতে দেওয়া, নিজেরা আইন হাতে তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, যার ফলাফল মোটেই ভালো হবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ‘প্রতিটি বিভাগে হাতেগোনা কয়েকজন করে আছেন, যারা অপরাধে সম্পৃক্ত ছিলেন। যে সন্ত্রাসী আমার মাথায় আঘাত করেছে, তার সঙ্গে আমি কেন পরীক্ষার হল শেয়ার করবো? তাদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না, এটা সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা।’
যা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পরীক্ষা না দিতে পারার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাউকে পরীক্ষা দিতে বাধা সৃষ্টি করছি না। বরং তারা যাতে পরীক্ষা দেয় সেদিকে আমরা তাদের বারবার উৎসাহ দিচ্ছি।’
সহপাঠীদের আপত্তির কারণে পরীক্ষা দিতে পারছে না জানালে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে অনুৎসাহিত করছে না। পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে যখন যে ধরনের সহযোগিতা চায় আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে চেষ্টা করি।’
এমএইচএ/এএসএ/জিকেএস