মতামত

ইতিহাসের ঐক্যের শেকড়ে ফিরতেই হবে

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের আকস্মিক সাক্ষাৎ রাজনীতিতে বহুমাত্রিক আলোচনা এবং সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। এই সাক্ষাৎ স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এর সময়কাল, পটভূমি এবং অংশগ্রহণকারীদের কারণে বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঘটনাটি তাই সব মহলেই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

Advertisement

একে শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ না ভেবে এর পেছনে ‘রাজনীতি’ও আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। গুলশানের ফিরোজা নামের একটি বাড়িতে তার সময় কাটে। বন্দিজীবন থেকে মুক্ত হওয়ার পরও তাঁকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সেভাবে সক্রিয় দেখা যায় না। কারণ তাঁর শারীরিক অসুস্থতা। চিকিৎসার জন্য তাঁকে দেশের বাইরে পাঠানোর দাবি দলের পক্ষ থেকে কয়েক বছর থেকে করা হলেও শেখ হাসিনার সরকার তা সব সময় উপেক্ষা করেছে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে প্রবল এক গণবিস্ফোরণের মুখে। তারপর দেশের রাজনীতির হিসাব ও চালচিত্র বদলে গেছে। খালেদা জিয়ার মামলা ও শাস্তি বাতিল হয়েছে। তিনি এখন মুক্ত মানুষ। তিনি রাজনীতিতে খুব সক্রিয় না থাকলেও বিএনপির দলীয় রাজনীতি আবর্তিত হয় তাঁকে কেন্দ্র করেই। তাঁর নাম রাজনীতিতে বহুল উচ্চারিত ও আলোচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যে সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকে সরল সৌজন্যের বাইরেও দেখতে চাইছে অনেকেই। বিশেষত খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। তাছাড়া এই সাক্ষাৎ এমন সময় ঘটেছে, যখন দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সেনাপ্রধানের এই সাক্ষাৎকে আনুষ্ঠানিকভাবে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার উদ্যোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এর পেছনে আরও কারণ খুঁজছেন। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও চিকিৎসার খবর নিয়মিতই প্রচারিত হয়ে আসছে। তা সত্ত্বেও এ ধরনের পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত ব্যতিক্রম। বৈঠকটি ৪০ মিনিটের বেশি সময় স্থায়ী হওয়ায় এটি কেবল সৌজন্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলেও মনে করা হচ্ছে।

Advertisement

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার বিষয়টি নতুন নয়। বিশেষত বাংলাদেশে অতীত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে সামরিক নেতৃত্বের প্রভাব বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পেছনেও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বড় ভূমিকা আছে। এ কারণেই খালেদা জিয়ার মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ নানামাত্রিক বার্তা বহন করছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্ন এবং আগামী দিনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে।

বিশেষ করে সাক্ষাতের সময় এবং পটভূমি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন প্রশ্নে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির টানাপড়েনের খবর গোপন নয়। আবার এই সরকার গঠনের পেছনে সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধানের যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সেটাও কারো অজানা নয়। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচনী পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ না হওয়ায় সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি এবং এর বাস্তবায়ন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীলতার বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। এরমধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সেনাপ্রধানের এই সাক্ষাৎটি ঘটে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, নির্বাচন-পূর্ববর্তী প্রস্তুতি এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে এই সাক্ষাৎ।

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ সংকটে ভুগছে। বিশেষত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দীর্ঘ প্রবাসজীবন এবং দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটি ফাঁকা জায়গা তৈরি করেছে। কৌশলে বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র চলছে বলেও প্রচার আছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অভ্যন্তরীণ বিবাদ, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন এবং রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে আসছে। এমন অবস্থায় দলীয় প্রধানের সঙ্গে সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎ দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মর্যাদা তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য স্থানে রেখেছে। তাঁর অসুস্থতা এবং সীমিত সক্রিয়তা সত্তে¡ও তাঁকে ঘিরে সামরিক এবং বেসামরিক স্তরে আলোচনা প্রমাণ করে যে তিনি এখনও রাজনৈতিক ভারসাম্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই সেনাপ্রধানের সৌজন্যমূলক এই সাক্ষাৎ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে একটি বার্তা হিসেবে ধরা দিচ্ছে।

Advertisement

রাজনীতি যতই বিচ্ছিন্ন করুক, ইতিহাস আমাদের ঐক্যের শেকড়। যে জাতি তার অতীত ভুলে যায়, তার ভবিষ্যৎ কখনো নিরাপদ নয়। অতএব একাত্তর আমাদের গৌরব, সেই গৌরবের সম্মান রক্ষা করা শুধু আমাদের রাজনৈতিক দায় নয়, এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বিএনপির নেতারা উল্লেখ করেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় থেকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, যেমন মাইনাস টু ফর্মুলা, দলে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এই সাক্ষাৎ ওই ষড়যন্ত্রকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারে বা তার পুনর্জাগরণকেও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সব মিলিয়ে বিষয়টি বিএনপির অনুকূলেই গেছে।

সাক্ষাৎটি আনুষ্ঠানিকভাবে যতই সৌজন্যমূলক দাবি করা হোক না কেন, এটি সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতির গভীরে প্রবেশের পথ তৈরি করেছে। এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থাকে আরও স্পষ্ট এবং দিকনির্দেশনামূলক করবে, বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচন এবং ভবিষ্যৎ শক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে। তবে এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এবং জনগণের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয়ে দু’একটা কথা বলা জরুরি মনে করছি। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি রংপুরে এক সভায় বলেছেন, দেশে পরীক্ষিত দুটি দেশপ্রেমিক শক্তি আছে, এর একটা সেনাবাহিনী আরেকটা জামায়াতে ইসলামী। তাঁর এই বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

জামায়াত প্রধানের বক্তব্য বিএনপি ভালোভাবে নেয়নি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘একাত্তরে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল? আপনারা কোন সেক্টরে, কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন? আপনারা ছাড়া বাংলাদেশে কেউ দেশপ্রেমিক নেই? এ ধরনের বিভ্রান্তি আপনারা সৃষ্টি করলে মানুষ হাসবে।’

এটা নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই যে একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির জন্য সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, মুক্তির স্বপ্ন। তবে সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কিছু রাজনৈতিক দলের অবস্থান নিয়ে আজও বিতর্ক শেষ হয়নি।

এটাও কারও অজানা নয় যে জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি ১৯৭১ সালে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। জামায়াতের শীর্ষ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠনের পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই বাহিনী জাতির ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যায় অংশ নিয়েছে, যা ইতিহাসের পাতায় কালিমালিপ্ত অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছেন, তারা নিজেদের ভুল স্বীকার না করে কীভাবে নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিতি দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।

তবে রিজভীর বক্তব্য থেকে বিএনপির নিজের অবস্থানের দ্বৈততা সামনে আসে। একাত্তরের বিরোধিতাকারী জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জোট বা মৈত্রী কৌশলগত হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। আবার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগও যে জামায়াতকে ছাড় দেওয়ার নীতি নেয়নি, তাও নয়।

রাজনীতিতে মতাদর্শিক পার্থক্য থাকা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়, তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে বিভ্রান্তি সৃষ্টি বা আপস করা কখনো স্বাভাবিক নয়।

আমাদের অতীত সঠিকভাবে জানা এবং তা নিয়ে সত্যনিষ্ঠ আলোচনা করার দায়িত্ব রাজনীতিকদের ওপরই বর্তায়। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে রাজনীতিতে বারবার বিতর্ক ওঠে, যা শুধু বিভেদ বাড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং এই ইতিহাসকে কেন্দ্র করে রাজনীতি নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের শেকড়ের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত।

বিএনপি যদি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে চায়, তবে তাদের উচিত জামায়াতের মতো দলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করা। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগেরও উচিত প্রতিপক্ষকে ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে চিত্রিত না করে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনার মাধ্যমে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া।

রাজনীতি যতই বিচ্ছিন্ন করুক, ইতিহাস আমাদের ঐক্যের শেকড়। যে জাতি তার অতীত ভুলে যায়, তার ভবিষ্যৎ কখনো নিরাপদ নয়। অতএব একাত্তর আমাদের গৌরব, সেই গৌরবের সম্মান রক্ষা করা শুধু আমাদের রাজনৈতিক দায় নয়, এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লেখক : রাজনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

এইচআর/জেআইএম