টেক্সটাইল-চামড়া শ্রমিকদের কল্যাণে ৮২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা অনুদান দিচ্ছে জার্মান উন্নয়ন সংস্থা (জিআইজেড)। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে ২৭ কোটি টাকা ব্যয়প্রস্তাব করা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের স্টাডি, পরামর্শ, আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ ফি ও অফিস ভাড়া খাতে। এসব ব্যয়সহ বেশ কিছু খাতের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
Advertisement
‘সোশ্যাল প্রটেকশন ফর দ্য ওয়ার্কার্স ইন দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড লেদার সেক্টর’ প্রকল্পের আওতায় এ ব্যয়প্রস্তাব করেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। ডিসেম্বর ২০২৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৭ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। এ প্রকল্পে জিআইজেড অনুদান দিচ্ছে। তারাই প্রকল্পের পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ব্যয়ও ঠিক করার হাত তাদের, এখানে আমাদের হাত নেই।- কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম-মহাপরিদর্শক মো. হাসিবুজ্জামান
কমিশন বলছে, যাদের জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে তাদের জন্য খরচে অবহেলা করা হয়েছে। টেক্সটাইল ও চামড়া শিল্পের মাত্র ৫০ জন শ্রমিকের পুনর্বাসনে ২৫ লাখ টাকা রাখা হয়েছে, যা অনেক কম। উভয় খাতে ৫০ জন করে মোট ১০০ জন শ্রমিকের পুনর্বাসন ও মাথাপিছু ব্যয় মানসম্মত হওয়া উচিত। এছাড়া কিছু ব্যয় নিয়েও কমিশন প্রশ্ন তুলেছে। প্রকল্পে অফিস ভাড়া বাবদ এক কোটি ৪২ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি পরিকল্পনা কমিশন। তাই এই অর্থ বাদ দিয়ে পোশাক-চামড়া শ্রমিকদের পুনর্বাসন খাতে খরচ করা যেতে পারে বলে মতও দিয়েছে কমিশন।
Advertisement
প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা করেছি। সভায় আমি বলেছি শ্রমিকদের কল্যাণে যেন ব্যয় বাড়ানো হয়। পরামর্শক ও বাড়িভাড়াসহ অন্য ব্যয় কমিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণ গুরুত্ব দিতে বলেছি।- পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান
জার্মান সংস্থার অনুদান দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য চামড়া-পোশাক শ্রমিকদের কল্যাণ। অথচ শ্রমিকদের কল্যাণে একটি মাত্র খাতে ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নানা খাতে কর্মকর্তাদের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে। এসব অযৌক্তিক ব্যয় বাদ দিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণে খরচের জন্য সাফ জানিয়ে দিয়েছে কমিশন।
আরও পড়ুন পরিবেশবান্ধব হবে রেলপথ, চাপ কমবে সড়কে দেশেই শতভাগ সংযোজন হবে পাসপোর্টের বুকলেট, রপ্তানির আশা বালিশকাণ্ড ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’, বন্ধ হওয়ার পথে অর্থায়ন ১৪০ থানা-ফাঁড়ি নির্মাণ প্রস্তাবের ব্যয় নিয়ে প্রশ্নশ্রমিকদের কল্যাণ অবহেলা করে অন্য খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা প্রসঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম-মহাপরিদর্শক (অর্থ ও পরিকল্পনা অধিশাখা) মো. হাসিবুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। এ প্রকল্পে জিআইজেড অনুদান দিচ্ছে। তারাই প্রকল্পের পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ব্যয়ও ঠিক করার হাত তাদের, এখানে আমাদের হাত নেই।’
তারা (জিআইজেড) যেভাবে অনুদান দিক, কীভাবে ব্যয় করবো এটা আমাদের বিষয়। অনুদানের টাকা বলেই খুশিমতো ব্যয় করবো এটা কোনো যুক্তি নয়। এটা বাদ দেওয়া উচিত। আসল লক্ষ্য শ্রমিকদের কল্যাণ। সেটাকেই ফোকাস করা জরুরি।- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও আইএনএম নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী
Advertisement
প্রস্তাবিত প্রকল্পটি নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্য ঝুঁকি উত্তরণের পরিকল্পনা/কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে কি না এ বিষয়ে সভায় আলোচনা করা যেতে পারে। প্রাক্কলিত ব্যয়ে ১০৫ জন দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক প্রফেশনালের জন্য ১৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ২১০ জন দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় প্রফেশনালের জন্য এক কোটি ৪৫ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে, যার যৌক্তিকতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এই দুটি খাতের ব্যয় কমিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণে ট্রেনিং পুনর্বাসনে ব্যয় করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে কমিশন। প্রাক্কলিত ব্যয়ে নিড বেজড জাতীয় পরামর্শকের জন্য চার কোটি ৭২ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। অথচ এ পরামর্শক তালিকায় দুজন আন্তর্জাতিক পরামর্শক আছেন। ট্রেনিং খাতে ১৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা রাখা হলেও কোন সেক্টরের (পোশাক/চামড়া) কতজন শ্রমিকের কী কী বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হবে তা স্পষ্ট নয়। শ্রমিকদের ট্রেনিং ও স্টাডি ট্যুরে সরকারি বিধি মোতাবেক ভাতার সংস্থান রাখা যেতে পারে। দুই সেক্টরের ৫০ জন শ্রমিক পুনর্বাসনের জন্য মাত্র ২৫ লাখ টাকা রাখা হয়েছে, যা অপ্রতুল। শ্রমিক সংখ্যা ও তাদের পুনর্বাসনের জন্য মাথাপিছু ব্যয় মানসম্মত হওয়া উচিত। স্টাডির জন্য দুই কোটি ৫৩ লাখ টাকা আবার চারটি স্টাডির জন্য আলাদাভাবে এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা সংস্থান ও ১২টি আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ ‘ফি’ বাবদ এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলনের যৌক্তিকতা আলোচনা করা যেতে পারে বলে মনে করছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা করেছি। সভায় আমি বলেছি শ্রমিকদের কল্যাণে যেন ব্যয় বাড়ানো হয়। পরামর্শক ও বাড়িভাড়াসহ অন্য ব্যয় কমিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণকে গুরুত্ব দিতে বলেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পের সারসংক্ষেপ সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তারপরও আপনারা জানেন প্রকল্পে অনুদান দেবে জিআইজেড। তারা ইআরডির সঙ্গে কী চুক্তি করেছে আমরা জানি না। চুক্তি যেহেতু অনেক আগে হয়েছে এটা নবায়ন করে শ্রমিকদের স্বার্থ আগে দেখার কথা বলা হয়েছে।’
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যটেক্সটাইল ও চামড়া সেক্টরের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ইআইএস পাইলটের সফল বাস্তবায়নে অবদানের পাশাপাশি টেক্সটাইল সেক্টরের শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের অর্থায়নে একটি স্থায়ী ক্ষতিপূরণ স্কিম বাস্তবায়নে ত্রিপাক্ষিক লিখিত সমঝোতা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ডিজিটাল শ্রমিক ডাটাবেজ ব্যবহার করে টেক্সটাইল ও চামড়া সেক্টরের সব শ্রমিকের জন্য সামাজিক বিমা চালু করা এবং সামাজিক বিমা স্কিম বাস্তবায়নের জন্য চারটি গবেষণা পরিচালনা করা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, অথবা অন্য কোনো চাপের কারণে কোনো এলাকায় সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি থেকেও এ সেক্টরের শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে তাদের সন্তান ও পরিবারের জন্য বিভিন্ন সুবিধা যেমন- মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বেকারত্ব, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, বৃদ্ধ বয়সে পঙ্গুত্ব প্রভৃতি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সুবিধা থাকবে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রমদেশি-বিদেশি ৩১৫ পরামর্শক সেবা, পাঁচটি অনুদান চুক্তি, ৮৯টি প্রশিক্ষণ, ৮৭টি ওয়ার্কশপ ও সেমিনার, ছয়টি সফটওয়্যার ক্রয়, ৩৫টি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক ক্রয়, ৩৫টি কম্পিউটার সফটওয়্যার ক্রয়, ১৮টি অফিস সরঞ্জামাদি ক্রয়, ৫৬টি আসবাবপত্র ক্রয়, ৫০ জনের পুনর্বাসনে সহায়তা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনুদানের টাকা দিলেই মিস ইউটিলাইজড করতে হবে এটা ঠিক নয়। অনুদানের টাকা দেখে জলে ফেলা যাবে না। এটা করলে আমাদের চরিত্র নষ্ট হবে। যে কোনো প্রকল্পেই আমরা অপচয় করতে থাকবো। পোশাক ও চামড়া শ্রমিকদের জন্য কল্যাণে পরামর্শক বা বাড়িভাড়া দরকার নেই। এটা নতুন করে আবিষ্কারের কিছু নেই। তাদের সমস্যা কী আমরা জানি। তার জন্য পরামর্শকও দরকার নেই। এটা বাদ দেওয়া উচিত।’ জিআইজেডের মতো করে অর্থ ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা আছে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা (জিআইজেড) যেভাবে অনুদান দিক, কীভাবে ব্যয় করবো এটা আমাদের বিষয়। অনুদানের টাকা বলেই খুশিমতো ব্যয় করবো এটা কোনো যুক্তি নয়। এটা বাদ দেওয়া উচিত। আসল লক্ষ্য শ্রমিকদের কল্যাণ। সেটাকেই ফোকাস করা জরুরি।’
এমওএস/এএসএ/জিকেএস