আন্তর্জাতিক

ভারতে ‍দুর্নীতি নিয়ে খবর করা সাংবাদিকের লাশ মিললো সেপটিক ট্যাঙ্কে

‘সাহসী’ সাংবাদিকতার জন্য অনেকের নজর কেড়েছিলেন ভারতের ছত্তিসগড়ের ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রকর। আবার অনেকের চক্ষুশূলও হয়ে উঠেছিলেন। আর সে কারণেই হয়তো ‘নৃশংসভাবে’ হত্যার শিকার হতে হয়েছে তাকে। সম্প্রতি ১২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে ‘দুর্নীতি’র খবর ফাঁস করেছিলেন মুকেশ। প্রশ্ন উঠেছে, এই তথ্য সামনে আনার জন্যই কি খুন হতে হলো তাকে?

Advertisement

শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ছত্তিসগড়ের বিজাপুর জেলার একটি বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে মুকেশের মরদেহ উদ্ধার হয়। তার মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় গোটা ছত্তিসগড়ে। এরই মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সেই অভিযুক্তদের মধ্যে মুকেশের এক তুতো ভাইও আছেন।

মুকেশের পরিচিত ও ঘনিষ্ঠরা বলছেন, ভয়ডর ছিল না তার। বেশ কয়েক বার তার ওপর হামলাও হয়। কিন্তু তার পরেও সত্য উদ্ঘাটনের খোঁজে ছুটে গেছেন বার বার। বিজাপুর, বস্তার জেলার অনেক দুর্নীতি ও অপরাধের পর্দা ফাঁস করেছেন। আর এই নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন মুকেশ।

সাংবাদিকতায় আসার পর মুকেশ বলেছিলেন, বস্তারের এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো সংবাদমাধ্যমগুলোতে কাটছাঁট করে দেখানো হয়। তাই এলাকার বিভিন্ন পরিস্থিতির ‘আনকাট’ ছবি তুলে ধরতে নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেলও খোলেন মুকেশ। নাম দেন ‘বস্তার জংশন’।

Advertisement

দেড় লাখ সাবস্ক্রাইবার ছিল সেই চ্যানেলের। মুকেশের এক পরিচিতের দাবি, তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা যখন হু হু করে বাড়ছিল, সেসময় তিনি তার দাদা যুকেশ চন্দ্রকরকে বলেছিলেন, মা যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে এই দিন দেখে খুব খুশি হতো। অনেক কষ্টের মধ্যে পড়াশোনা করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছি।

জানা গেছে, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না মুকেশদের। ২০০৫ সালে বিজাপুরে বাসাগুড়া গ্রামে চলে আসেন তারা। সেখানে তখন দশম শ্রেণি পাশ করাই অনেক বড় বিষয় ছিল। অল্প বয়সেই মাকে হারান মুকেশ। মায়ের মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন দুই ভাই।

মুকেশের এক পরিচিত জানান, সংসার টানতে গ্যারাজেও কাজ করতে হয়েছে তাকে। খবু কাছ থেকে এলাকার সমস্যাগুলো দেখার পর, ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আনতে সাংবাদিকতার পথ বেছে নেন। মুকেশের দাদা যুকেশও পেশায় সাংবাদিক।

স্থানীয় সূত্রের খবর, কোনো নতুন খবর করলেই মুকেশ এলাকার লোকজনদের ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন, ঠিক হয়েছে কি না। বিজাপুর ও বস্তার চিনতেন হাতের তালুর মতো। বছর দুই-তিনেক আগে রাওঘাট প্রকল্প নিয়ে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হামলার শিকার হন মুকেশ।

Advertisement

বস্তার জেলার মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে খবর করেছিলেন মুকেশ। গঙ্গালুর থেকে হিরোলি পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছিল ৫০ কোটি টাকার। কিন্তু, পরে সেই নির্মাণ খরচ ১২০ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদার সুরেশ চন্দ্রকরের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য সরকার।

শনিবার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে তিন জনকে। এর মধ্যে অন্যতম অভিযুক্ত রীতেশ চন্দ্রকর মুকেশের তুতোভাই। এছাড়া দীনেশ চন্দ্রকর নামে আরও এক আত্মীয় ও মহেন্দ্র রামতেক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে ছত্তিসগড় পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার দিন চন্দ্রকর তার ভাই রীতেশ ও মহেন্দ্র রামটেকের সঙ্গে সুরেশ চন্দ্রকরের বাড়িতে নৈশভোজ করেছিলেন। সেই সময়ে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। রীতেশ ও মহেন্দ্র লোহার রড দিয়ে আক্রমণ করে মুকেশকে। হত্যার পরে সাংবাদিকে দেহ একটি সেপটিক ট্যাঙ্কে লুকিয়ে রেখে সিমেন্ট দিয়ে ট্যাঙ্কের মুখ জমিয়ে দেওয়া হয়।

এদিকে, মুকেশের এই হত্যাকাণ্ডে দেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া। একটি বিবৃতিতে সব সাংবাদিক, বিশেষ করে- ছোট শহর ও গ্রামীণ এলাকায় কাজ করা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে তারা। সেই সঙ্গে ভারতের সরকারকে মুকেশ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি।

সূত্র: আল জাজিরা

এসএএইচ