৪ জানুয়ারি দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রে ছিল জনপ্রিয় অভিনেতা ও গায়ক তাহসানের সঙ্গে মেকওভার আর্টিস্ট রোজা আহমেদের বিয়ে। শুধু তাই নয়, তাদের বিয়ে নিয়ে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। উঠে আসে রোজার অতীতের কর্মকাণ্ড। সেই সঙ্গে ভাইরাল হয়ে যায় ২০২৪ সালের ৪ জুন সোশ্যাল মিডিয়ায় করা একটি পোস্ট। রোজা’স ব্রাইডাল মেকওভার পেজ থেকে করা পোস্টটি জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
Advertisement
‘‘আলহামদুলিল্লাহ! এইমাত্র নিউইউর্ক সিটিতে আমার রোজাস ব্রাইডাল মেকোভার অ্যান্ড বিউটি কেয়ার সেলুনের ডেকোরেশন এবং সেটআপের কাজ শেষ হলো।
সেলফিটা একটু আগেই তুলেছি। সাধারণত আমার অনেক ছবি তোলা হয়। কিন্তু আজ এই সেলফিটা তোলার সময় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক সময় ধরে কাঁদলাম। কিন্তু কী মনে করে কাঁদছি বা কেন কাঁদছি, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। তাই সব থেকে আদরের ছিলাম সবার। আর বাবা আমাকে সব সময় বলতো, “আমার ছোট্ট পরিটা কইরে”। সেই সময় বরিশাল শহরে আমাদের পরিবারের বেশ প্রভাব ছিল। ছোটবেলায় কখনো কমতি পাইনি। এর বাসায় দাওয়াত, তার বাসায় দাওয়াত আর যেতেই হবে। কারণ আমাদের ছাড়া দাওয়াত অসম্পূর্ণ হবে। এমন দিন গেছে, দিনে ৪টা দাওয়াতেও অংশ নিয়েছি। শুধু দেখা করে আসার জন্য।
হঠাৎ বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ওপারে। যতদিনের হায়াত তিনি নিয়ে এসেছেন; ততদিন ছিলেন আমাদের সাথে। অভিযোগ তো অনেক জমা আছে, বাবার সেই ছোট্ট পরিটার, কিন্তু অভিযোগ কার কাছে করবো? আর বাবা শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যায়নি, সাথে সাথে যে মানুষগুলো আমাদের এতো সম্মান করতেন; তাদের ভালোবাসাও চলে গেল আমাদের ওপর থেকে। আর সেই দিনটাতেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, যে ভালোবাসা আমরা পেয়েছি; তা সবই বাবাকে ঘিরে আর সাথে অনেক অনেক স্বার্থ। বাবা চলে যাওয়ার ঠিক ২ মাসের মাথায় আমার এক রিলেটিভের বিয়ে। আমরা অনেক ঘনিষ্ট ছিলাম একে ওপরের কিন্তু বিয়েতে দাওয়াত পেলাম না। যে রিলেটিভরা সেই বিয়েতে অংশ নিয়েছে, সবাই ফোন করতে শুরু করলো মাকে। কেন আমরা গেলাম না, কোথায় আমরা? বরিশালে আছি কি না এই-সেই। সেদিন সারারাত বসে দেখেছি মায়ের সেই সরল মনের কান্না। আপনারা লেখাটা পড়ে ভাবতে পারেন, দাওয়াত পাইনি বলে কাঁদছি? কিন্তু দাওয়াতের জন্য নয়, একই দালানে সবাই আনন্দ করছে। আমি, মা আর ছোটো ভাই উৎস তখন বাসার এক কোণে। খুব চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, বাবা তুমি একটু দেখে যাও, যাদের জন্য এত করেছো; তারা আমাদের সব ফিরিয়ে দিচ্ছে।
Advertisement
বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছুই রেখে গেছেন। দাদা ভাইয়ের অনেক আছে কিন্তু কিছুই গোছানো না। কে বুঝেছেন যে এত অকালে উনি চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে! আর দাদার সব সম্পত্তিতেই চাচা-ফুফুদের ভাগ আছে। মায়ের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ পায়নি। আর আমি চলে আসি তাদের কোলে। আমার মা খুব সরল মনের, দিন-দুনিয়ার কিছুই বোঝে না। সে যে নিজের ভয়েস রেইস করবে বা তার সেটা রেইস করার অধিকার আছে; সেটা তার ধারণার বাইরে। কখনো তার সেই সাহসটাই ছিল না যে তার শ্বশুরকে বলবে, বাবা আমাদের সম্পত্তিটুকু আমাদের বুঝিয়ে দেন। আর উৎস তো তখন অনেক ছোট। আমারা দুই ভাই-বোন তখন পিচ্চি পিচ্চি। আমাদের পড়াশোনার খরচ তখন একদম হিসাব করে টায় টায় দেওয়া হতো মায়ের হাতে। তাই কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলতাম না, যাতে উৎস যেটা চায় সেটা যাতে পায়। আমার দিক থেকে একটু কম হলেও সমস্যা নেই।
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রস্তাব আসা শুরু করে। এই রিলেটিভ একে আনে, ওই রিলেটিভ ওকে আনে। সেই সময় আমি প্রথম ভয়েস রেইস করেছি যে, আমার বয়স কম আর বাবা মারা গিয়েছে কী হয়েছে। বাবার আর আমার স্বপ্ন তো মারা যায়নি! ওইদিন কথাটায় খুব মাইন্ড করেছিল আমার কাছের লোকজন। বড়দের মুখে মুখে কথা, আমি আর মানুষ হবো না। আর সেই থেকেই রটানো হয় কতো কথা। সারাদিন নাকি ছেলেদের সাথে ঘুরি, আমার বন্ধু-বান্ধব সার্কেল ভালো না, পর্দা করি না আরও কতো কী। মেয়ে তো নিশ্চয়ই প্রেম করে আর না হলে এতো ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়?
প্রতিদিন এভাবেই বাসায় অভিযোগ আসা শুরু করে। কিন্তু আমার ভয়েস রেইসে সবাই এভাবে রিঅ্যাক্ট করবে বুঝতে পারিনি। আমার মা এত অভিযোগ শুনতে শুনতে বললো, তুই আমাকে ছুঁয়ে বল এই সব অভিযোগ কি সত্যি। আমি মাকে ছুঁয়ে বললাম, না মা সব মিথ্যে। আমি তো স্কুল আর বাসা বাদে কোথাও যাই না। এই বলে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলাম মায়ের সাথে। ওইদিনের পর থেকে মা আমার সাথে নিয়মিত কোচিংয়ে যেত আবার এসে বাসার সবার জন্য রান্না করতে হতো, খুব কষ্ট হয়ে যেত তার। তখন নিজের কাছে মনে হতো আমি সবার জন্য একটা বোঝা, সব ক্ষেত্রেই আমার দোষ। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। হঠাৎ দাদাভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সেই থেকে আমার সাথে কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করেন মা। কারণ তাদের সেবা-যত্ন করতে হতো মাকেই।
তখন থেকেই একা একা চলা শুরু করলাম। একটা ফ্রেন্ড বললো, ও স্টুডেন্ট পড়ায়। আমি বললাম, আমাকে একটা খুঁজে দিবি? আমিও শুরু করতে চাই। বেশ একজন খুঁজতে গিয়ে দুজনকে পেয়ে গেলাম। কেজিতে পড়ে, খুব অল্প টাকা বেতন। আর কোচিংয়ের পড়া আমার ভালো লাগত না। তাই আমি নিজে নিজে বুঝে পড়তাম কিন্তু বাসার কথা ছিল কোচিংয়ে পড়তেই হবে। তাই কোচিংয়ের সময়টা আমি স্টুডেন্ট পড়াতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। সেই টাকা জমিয়ে উৎসকে ঘুরতে নিতাম, কিছু একটা পছন্দ করলে কিনে দিতাম। বাবার যে আদর আমি পেয়েছি ও সেই আদর পায়নি। তাই বাবার আদর হয়তো দিতে পারতাম না। তবে কখনো যাতে আফসোস না করে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। আবার নিজের খরচটাও একটু বাড়ল, ওয়াইফাই ছিল না। তাই এমবি কিনে ফেসবুকিং শুরু করি। এভাবেই তিন মাস চলল।
Advertisement
হঠাৎ বাজারে দাদা ভাইয়ের সাথে স্যারের দেখা। স্যার তো বললো, রোজা আসে না কেন? এরপর কী হতে পারে, যারা ফেস করেছেন তারা বুঝবেন। শুরু হয়ে গেল বাসায় বিচার সালিশ। যেহেতু সত্যি আমি কোচিংয়ে যাইনি। তাই আমার জোর গলায় কথা বলার মুখ ছিল না। আর কোচিংয়ের টাকা বন্ধ করে দিলো। আর বলল, তুই তো একা একাই সব পারো। তো কোচিংয়ে পড়তে হবে না। আর টিউশন দুটাও বাদ দিতে হলো। এখন স্কুল আর বাসা। স্কুলে আমি অনেক পপুলার ছিলাম নাচের জন্য। ওহ ক্লাস থ্রিতে থাকতে নাচের জন্য আমি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। আর তখন থেকেই একা একা সাজতাম আর যারা আমার সাথে নাচ করতো ওদেরও সাজিয়ে দিতাম। সবাই আমার সাথে চলতে চাইতো বিশেষভাবে মেয়েরা। কারণ আমি খুব ভালো সাজাতে পারি।
আরও পড়ুনভারতের মিডিয়ার বিরুদ্ধে সরব বাংলাদেশের নেটিজেনরাশ্রীজাতের কবিতার জবাবে নেটদুনিয়ায় প্রতিবাদআমার এক দূরের কাজিনের বিয়ের প্লান ছিল ঢাকা থেকে আর্টিস্ট আনবে। তখন বরিশালে ফ্রিল্যান্সার আর্টিস্টের নামটার সাথে কেউ পরিচিত ছিল না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মেয়েটা ঢাকার আর্টিস্ট আনতে পারেনি। আমাকে কল দিয়ে খুব মন খারাপ করে বললো, পরিবার বিয়েতে অনেক খরচ করছে। এত বড় আয়োজন কিন্তু মেকআপের জন্য এত টাকা দেবে না। বরিশালের কোনো পার্লারের সাজ আমার পছন্দ না। তোর সাজটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি একটু চুপ থেকে বললাম, আপু তোমার এত বড় বিয়ের আয়োজনে আমার কাছে সাজবা শিওর তুমি? বললো, হ্যাঁ তোর মতো করে আমাকে সাজিয়ে দিস তাহলেই হবে।
সেই থেকে মেকআপের প্রফেশনাল জার্নিটা শুরু। এরপর আপুকে সাজালেও খুব ভয় হচ্ছিল, আমি কি বিয়েতে যাবো? কারণ কেমন না কেমন হয়েছে সাজ? মা জোর করে নিয়ে গেল। সবার এত প্রশংসা আর ফিডব্যাক পেয়ে আমি নিজেই হতভম্ব। এরপর থেকেই আপুর অনেক ফ্রেন্ড আমার কাছে সাজা শুরু করল। মাত্র ২ হাজার টাকা করে নিতাম। তবে সেই বাসার সমস্যায় আবার পড়লাম। দাদা ভাইকে বলা হলো আমি পার্লারের কাজ করি, পার্লারের মেয়ে আমি। আমি বললাম, হ্যাঁ তো? পার্লারে যারা কাজ করে ওরা কি মানুষ না? তাদের কি পরিবার নাই? দেখো তোমাদের মতো এক একটা পরিবার চালায় তারা। আমি তাদের রেসপেক্ট করি। সেদিন সবাই অনেক উচ্চ কণ্ঠে আমাকে বললো, এই মেয়ে আমাদের মান-সম্মান ডুবাবে। সেদিন অনেক জেদ হলো!
শুরু করলাম ফ্রিল্যান্সার মেকআপ আর্টিস্টের কাজ। বরিশাল শহরে কেউ এই টার্মটার সাথে পরিচিত ছিল না কিন্তু এখন শত মেয়ে ফ্রিল্যান্সার মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছে দেখে খুব গর্ব হয়। যেহেতু বিয়েগুলো দুপুরে হতো ম্যাক্সিমাম। তাই অনেক সময় ব্রাইডের কাজ করতে গিয়ে স্কুল বন্ধ দিতাম। স্কুল ব্যাগে মেকআপ প্রডাক্ট নিয়ে চলে যেতাম সোজা ক্লায়েন্টের বাসায়। ছুটির সময়ে চলে আসতাম বাসায়। আর সেই খবর বাসায় চলে আসে। ওইদিন রাতে বুঝে যায়, আমাকে যদি কিছু বলতে আসে আমি কাউকে ছাড় দেবো না। তাই এবার আর আমাকে না বলে মাকে অনেক মন্দ বলে। মায়ের সেই সরল কান্না যতবার দেখেছি, নিজের জেদকে আরও শক্তিশালী করেছি। নিজেকে তৈরি করেছি মানুষ হিসেবে, একবারও নারী হিসেবে নয়। ব্রাইডের পরিমাণ বাড়তে থাকে। বরিশাল থেকে পুরো দেশে নাম ছড়িয়ে পড়ল। বাসায় ফাইন্যান্সিয়ালি কন্ট্রিবিউশন করা শুরু করলাম। বাহ এবার আমার পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করছে, পরিচয় দিচ্ছে। আমি সবার মধ্যমণি। কিন্তু ওইদিনটাতে বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল যে, বাবা তোমার মৃত্যুর পর যতটা কষ্ট পেয়েছি; তোমাকে হারিয়ে তার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে।
ব্রাইডাল মেকআপ ট্রান্সফরমেশন ভিডিও আপলোড শুরু করলাম। নিজের ব্লগ, সবকিছু মিলিয়ে ভাইরাল হওয়া শুরু হলো। ঢাকা থেকে ক্লায়েন্টের নক আসা শুরু করল। কিন্তু ঢাকায় তো কারো বাসায় উঠবো না। অন্যদিকে পরের দিন বরিশালে ৪-৫টা ক্লায়েন্ট। তাই সারাদিন কাজ করে রাত ৯টায় লঞ্চে করে ঢাকা এসে সারাদিন কাজ করে আবার বরিশালে ব্যাক করি। এই যাতায়াত করতে গিয়ে রাস্তাঘাটে কত মানুষের কথা শুনেছি। তবে আমাকে কেউ নারী বলে হ্যারেসমেন্ট করার সাহস পায়নি। কারণ আমার চোখ তাদের বলে দিতো যে, আমি জীবনে কাউকে ছাড় দিই না, দেব না। তা বাসায় হোক আর বাইরে হোক।
ঢাকার ক্লায়েন্টের পরিমাণ বাড়ল, বাজেট বাড়ল। বিবিএ’র স্টুডেন্ট ছিলাম। কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে বেশ একটা কঠিন সময় যাচ্ছিল। যা-ই হোক, খুব সাহস করে বসুন্ধরায় একটা ছোট বাসা নিয়ে স্টুডিও সেটাপ দিই। বাড়িওয়ালা খুব ভালো ছিলেন। তার পরিবার নিয়মিত আমার ব্লগ দেখতেন। কিন্তু এত ক্লায়েন্ট আসত যে, পাশের বাসা থেকে কমপ্লেইন আসা শুরু করল। পরে বাসাটা ছেড়ে একটু বড় পরিসরে বাসা নিয়ে আবার নতুন সেটাপ দিই। এবার দারোয়ান মামাকে বেশ ভালো বকশিস দিই তাই আর ঝামেলা হয় না। এভাবেই আস্তে আস্তে রোজাস ব্রাইডালকে ক্লায়েন্টের দোরগোড়ায় নিয়ে যাই।
ঢাকা-বরিশাল সব সময় ক্লায়েন্ট। পরে ফ্লাইটে যাতায়াত শুরু করি। এমন হয়েছে সকালে বরিশালে ক্লায়েন্ট করে দুপুরে ঢাকায় ক্লায়েন্ট করেছি। আর তা সব সম্ভব হয়েছে মনের মধ্যে একটা জেদ ছিল। কারণ এই সেক্টরের মেয়েরা অনেক অবহেলিত। আমাকে যে কথা শুনতে হয়েছে, আমি আর একটি মেয়েকেও সেই কথা শুনতে দিতে চাই না। তাই শুরু করলাম মেকআপ ক্লাস। এক বছরে ৫০০+ মেয়েকে মেকআপ শেখালাম। শত শত মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াল। হঠাৎ একদিন মায়ের কল, ইউএসএ অ্যাম্বাসিতে দাঁড়াতে হবে ইমেগ্রেশন ভিসার জন্য। বড় মামা অনেক আগে থেকে আবেদন করেছিল। দেখতে দেখতে ভিসা হয়ে গেল। উৎস আর মায়ের জন্য দেশ ছাড়তে হবে। নিজের সাজানো সংসার বলা যায়, তা ছেড়ে যেতে যেমন লাগে। দেশ ছেড়ে আমার যেতে ঠিক তেমন লেগেছে। একটু একটু করে এ দেশে নিজের অবস্থান তৈরি করেছি আর সেই সব ছেড়ে যাবো?
মজার কথা হলো, যেদিন আমার ফ্লাইট; ওইদিনও আমি ব্রাইডের কাজ করি। দেশে আমার সার্কেলটা খুব ভালো। দেশ ছাড়ার সময়ে আমি নিজের লাগেজ পর্যন্ত গুছাইনি। যা কিছু করার সব ওরা করেছে। ওদের ছেড়ে থাকাটাও আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। নিজের ক্যারিয়ার, নিজের সার্কেল আর নিজের স্বপ্ন সব ফেলে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ নিয়ে চলে আসলাম ইউএসএতে। এখানে আমি আসার আগেই বার্গারের দোকানে কাজ থেকে শুরু সব কাজ আমার জন্য দেখা হয়েছিল, আমাকে না জানিয়েই। আমি তো করবোই না, ওইযে আমি খুব জেদি শুরু করলাম নিউইয়র্কে প্রচারণা। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ক্লায়েন্ট পেলাম যাওয়ার। আস্তে আস্তে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানের প্রবাসীরাও আমার কাছে সাজা শুরু করল, ক্লাস করা শুরু করালাম।
নিজেকে আবার এই দেশেও একজন প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড় করালাম। কসমেটোলজির মাধ্যমে স্কিন, হেয়ার এবং মেকআপ রিলেটেড স্ট্যাডি করলাম কলেজে। আর সেখান থেকেই আজকের স্টুডিও। কসমেটোলজির ওপর নতুন করে আবার পড়াশোনা, লাইসেন্স নেওয়া সব চ্যালেঞ্জ নতুন করে আবার ফেস করেছি। সেলুনে সব থেকে এক্সপেন্সিভ এবং কোয়ালিটিফুল প্রডাক্ট দিয়ে সাজিয়েছি সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট।
তাহসানের বিয়ের খবরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনাকথাগুলো খুব আবেগ নিয়ে লেখা। শুরুতেই বলেছিলাম, আমার মা একজন সরল মানুষ। বাবা মারা যাওয়ার পর জীবনে উচ্চৈস্বরে কথা বলতে পারে নাই। কখনো হাসতে দেখিনি। আজ সেই মা উচ্চ গলায় সবাইকে ফোনে বলে, ‘হ্যাঁ আমার বড় মেয়ে রোজাই তো আমাকে দেখছে। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ অনেক ভালো রাখছেন আমাদের।’ সে হয়তো স্বপ্ন দেখতে পারেনি কিন্তু তার মেয়ে হিসেবে একটু হলেও নতুনভাবে বাঁচতে শেখাতে সাহায্য করেছি।
আজ খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বাবা তোমার সেই ছোট্ট পরিটা অনেক বড় হয়েছে! আমার সব স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু তুমি বাবা। আজ যখন সেলফিটা তুলি, আমি একটার বেশি ছবি তুলতে পারিনি। কারণ এত কান্না আসছিল। আমি শুধু একটা কথা বলবো, আপনাদের ভেঙে দেওয়ার জন্য হাজার মানুষ থাকবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপনাকে একাই চলতে হবে। নিজেকে এমনভাবে গড়তে শিখুন যে, যতবার বাধা আসবে; ততবার হাসিমুখে মোকাবিলা করুন। যাতে বাধা দেখলেও আপনাকে ভয় পায়।’’
এসইউ/জেআইএম