শীত তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে ছয়শ থেকে সাতশোর মতো শিশু। এমন অবস্থা যে হাসপাতালের সামনে তাঁবু গেড়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ডায়রিয়া আক্রান্তদের।
Advertisement
মহাখালীর হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান গেটের পরই বড় করে টানানো হয়েছে তাঁবু। যদিও এখনো সেখানে বেড করার প্রয়োজন পড়েনি। হাসপাতালের প্রধান ভবনের শুরুতেই নার্সরা এন্ট্রি নিচ্ছেন এবং চিকিৎসকরা রোগীদের দেখভাল করছেন। এই দুই বুথে ভিড় লেগেই আছে সারাদিন। এর ভেতরেই ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু ও বয়স্করা। আর আউটপেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট (ওপিডি) এ শিশুদের খাওয়ানো হচ্ছে স্যালাইন।
ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ইমার্জেন্সি রুমের বেডে তিন বছরের শিশু মুসাকে নিয়ে শুয়ে আছেন তার বাবা মো. বিপ্লব হোসেন। তারা এসেছেন কেরানিগঞ্জ থেকে। দুদিন ধরে ছেলের মাঝে মাঝে পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। শুক্রবার অনেক বেশি বেড়ে যায়, সঙ্গে জ্বরও আসে। এজন্য রাতেই তাকে নিয়ে আইসিডিডিআর, বিতে ছুটে আসেন তিনি।
পাশের আরেকটি বেডে ছেলে মো. ইউসুফ আলীকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা শারমিন আক্তার। তারা এসেছেন জামালপুর থেকে। ছেলে ইউসুফ আলীর বয়স ১১ মাস। প্রায় ছয় দিন ধরে পাতলা পায়খানা ইউসুফের। জামালপুরে চিকিৎসক দেখানো হলেও লাভ হয়নি। তাই ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাকে স্যালাইন খাওয়াতে।
Advertisement
হাসপাতালে আগত শিশুদের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে গুরুতর না হলে কিছু সময় চিকিৎসা ও স্যালাইন খাইয়ে ও পরামর্শ মোতাবেক ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এ বছর ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশিআইসিডিডিআর,বির তথ্য বলছে, শনিবার (৪ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৬৭ জন ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। অন্যদিকে, শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ৬৪৮ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে আসেন। ২০২৫ সালের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি চিকিৎসা নেন ৮৫০ জন।
আইসিডিডিআর,বির তথ্য বলছে, শনিবার (৪ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৬৭ জন ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। অন্যদিকে, শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ৬৪৮ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নেন। ২০২৫ সালের প্রথম দিন, ১ জানুয়ারি চিকিৎসা নেন ৮৫০ জন। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৮০ শতাংশই শিশু।
এর আগে ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ৮৯১ জন, ২৯ ডিসেম্বর ৮২৬ জন, ৩০ ডিসেম্বর ৯১৩ জন, ৩১ ডিসেম্বর ৮৮৪ জন।
Advertisement
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে গড়ে ৮৫০ থেকে ৯০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৮০ শতাংশই শিশু।
আরও পড়ুন বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ, আইসিডিডিআর,বিতে রোগীর ভিড় ডায়রিয়া থেকেও হতে পারে কিডনি বিকল, যেভাবে সতর্ক থাকবেন ডায়রিয়া হলে যা খাবেন, যা খাবেন নাআইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ কমিউনিকেশন ম্যানেজার এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান বলেন, প্রতিবছর শীত এলেই ডায়রিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। বিশেষ করে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই চার মাস রোটাভাইরাসের প্রভাব বেশি থাকে।
তিনি আরও বলেন, আইসিডিডিআর,বিতে ভর্তি ৫০তম রোগীর টয়লেট পরীক্ষা করে দেখা হয়- ডায়রিয়ার কারণ ভাইরাস নাকি ব্যাকটেরিয়াজনিত। পরীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীর ডায়রিয়া হচ্ছে রোটাভাইরাসের কারণে। বাকি ৫০ শতাংশ অন্য ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার কারণে।
ভাইরাল ইনফেকশনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত বেশিআইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ডা. লুবাবা শাহরিন জাগো নিউজকে বলেন, গরম ও শীতকালের ডায়রিয়া ভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। এই শীতকালে যে ডায়রিয়া হচ্ছে তার বড় কারণ ভাইরাল ইনফেকশন। আমরা এখানে আগত রোগীদের স্টুল টেস্ট করে দেখেছি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া হচ্ছে রোটাভাইরাসের কারণে। প্রতিবছর শীতকালে ডায়রিয়া রোগী আসে। তবে এ বছর আমরা এর পরিমাণ একটি বেশি পাচ্ছি। গত দুই সপ্তাহে এখানে ৮০০ থেকে ৯০০ এর মতো রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি। আর আসা রোগীদের মাঝে ৮০ শতাংশই ছিল পাঁচ বছরের নিচের বয়সী শিশু। এতে আমরা ধারণা করছি এই ভাইরাল ইনফেকশনে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
গরম ও শীতকালের ডায়রিয়া ভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। শীতকালে যে ডায়রিয়া হচ্ছে তার বড় কারণ ভাইরাল ইনফেকশন। সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া হচ্ছে রোটাভাইরাসের কারণে। রোগীদের মাঝে ৮০ ভাগই পাঁচ বছরের নিচের বয়সী শিশু।-আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ডা. লুবাবা শাহরিন।
ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে কখন হাসপাতালে আনতে হবে?এ বিষয়ে শারমিন বলেন, অতিরিক্ত বমি করলে, কিছু খাওয়াতে না পারলে, আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিলে, অনেক জ্বর থাকলে, পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বমিরও একটা বিষয় আছে, ঘণ্টায় যদি তিনবারের বেশি বমি করে, তার মানে সে কিছুই পেটে রাখতে পারছে না। স্যালাইন দিচ্ছেন আর সে বের করে দিচ্ছে, তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে। ভাইরাল ডায়রিয়ায় জ্বর থাকে। কিন্তু যদি অতিরিক্ত জ্বর থাকে, তাহলেও হাসপাতালে আনতে হবে। শিশুর মানসিক আচরণে পরিবর্তন হলে। শিশু যে রকম হাসিখুশি থাকে, খেলাধুলা করে, যাদের ডায়রিয়া হয় তাদেরও কিন্তু অ্যাক্টিভিটি স্বাভাবিকই থাকে। যদি দেখা যায় বাচ্চা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে, ঘাড় সোজা করে রাখতে পারছে না, শিশুর মুখে খাবার দেওয়া যাচ্ছে না অথবা ভীষণ খিটখিটে হয়ে গেছে, অর্থাৎ কোনোভাবেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। এই পরিবর্তনগুলো অ্যালার্মিং সাইন। তাহলে শিশুকে হাসপাতালে আনতে হবে।
ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়ার আগে দুইভাবে প্রতিরোধ করা যায়ডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেও সচেতন থাকা যায়। এটি দুইভাবে প্রতিরোধ করা যায়। একটা হচ্ছে ভ্যাকসিন দিয়ে। তাহলে আশঙ্কা কমে যায়। এটা তিন মাস বয়স থেকেই দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, বিশুদ্ধ পানি ও গরম খাবার খাওয়ানো। হ্যান্ড হাইজিনটা ভালোভাবে মেইনটেইন করতে হবে। মলমূত্র ত্যাগ করার পর শিশুকে পরিষ্কার করে সাবান দিয়ে হাত অবশ্যই ধুতে হবে। শিশুকে প্রতিবার খাবার খাওয়ানোর আগে হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে।
এ ধরনের ডায়রিয়ায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় নাডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, রোটা ভাইরাসে ডায়রিয়া আক্রান্ত অবস্থায় দেহে পানিশূন্যতা হয়। এতে করে সাধারণ স্যালাইন খাওয়ালে সঙ্গে জিংক ওষুধ খাওয়ালেই সেরে যায়। তবে আমরা কিছু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে এই অসুস্থতার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক লেখা দেখি। যা খুবই খারাপ। এই রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় না। ৫ থেকে ৭ দিনে এই ভাইরাল ইনফেকশন থেকে এমনিতেই সেরে ওঠে আক্রান্তরা। তবে অন্যান্য শারীরিক জটিলতা থাকলে সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে সঠিকভাবে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
শিশুরা অতিরিক্ত বমি করলে, কিছু খাওয়াতে না পারলে, আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিলে, অনেক জ্বর থাকলে, পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।-আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ডা. লুবাবা শাহরিন।
বয়স ও ওজন অনুযায়ী স্যালাইন না খাওয়ালে শিশুদের জটিলতা দেখা দিতে পারেস্যালাইন ডায়রিয়ার জন্য অবশ্যই ওষুধ হিসেবেই খাওয়াতে হবে। সঠিক নিয়মেই বানাতে হবে। বাজারে যে ওরস্যালাইন পাওয়া যায় তার পেছনে নির্দেশনা লেখা থাকে, সে অনুযায়ী খাওয়াতে হবে। বেশিরভাগ স্যালাইনকেই আধালিটার বোতলে মিশ্রণ করতে হয়। এরপর বয়স অনুযায়ী পরিমাণ মতো খাওয়াতে হয়। যেমন সাধারণত শিশুর বয়স যত তত চা চামচ স্যালাইন খাওয়ানো বাচ্চার জন্য যথেষ্ট। যতবার তাদের স্টুল পাস বা পাতলা পায়খানা হওয়ার পরে ওজন অনুযায়ী এক চামচ করে (১০ কেজি হলে ১০ চামচ) স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
আরও পড়ুন চুয়াডাঙ্গায় বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী, বেশি আক্রান্ত শিশু বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ, স্যালাইন সংকট এক সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালেস্যালাইন বানাতে ভুল বা পরিমাণের চেয়ে বেশি খাওয়ানো হয় তা থেকে শারীরিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। রক্তে সোডিয়াম বা লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়। শিশুদের হাইপানেট্রিমিয়ার মতো জটিল সমস্যায় পড়তে হয়। এতে শিশুর খিচুনি হয়, অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। তাদের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অন্যদিকে, পরিমাণে কম খাওয়ালেও শিশুদের পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
এএএম/এসএনআর/এমএস