সারি সারি হাঁড়িভর্তি গুড়। কোনোটার মুখ পলিথিন দিয়ে ঢাকা আবার কোনোটার খোলা। ব্যাপারী ও ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে হাটে যেন পা ফেলার জায়গা নেই। দর কষাকষি করে গুড় বেচাকেনা চলছে। পরে এসব গুড় গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এটিই সরোজগঞ্জের ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাটের পরিচিত দৃশ্য।
Advertisement
শীত জেঁকে বসার সঙ্গে জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ গুড়ের হাট চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের ‘সরোজগঞ্জ গুড়ের বাজার’। এটি ‘সরোজগঞ্জ গুড় হাট’ নামেই বেশি পরিচিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি হাটে গুড় কিনতে আসেন শত শত ক্রেতা। খেজুরগাছ থেকে সংগ্রহ করা রস দিয়ে তৈরি ঝোলাগুড় ও নলেন গুড়ের পাটালি বেচাকেনার জন্য এই হাটের নামডাক দেশজুড়ে।
সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে স্থানীয় সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এ হাটের অবস্থান। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। তবে ট্রাক লোডসহ অন্যান্য কার্যক্রম চলে সন্ধ্যা অবধি। প্রতি সপ্তাহে এ হাটে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হয়। মাটির হাঁড়ি বা ভাঁড়ের আকার ও ওজনভেদে দাম ওঠানামা করে। প্রতিকেজি গুড় ২০০-২৫০ টাকা এবং এক ভাঁড় গুড় ৯০০-২৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
হাট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর এ হাট থেকে বেচাকেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০-৬০ কোটি টাকা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, পঞ্চগড়, সিলেট, খুলনা, রংপুর, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা আসেন গুড় কিনতে।
Advertisement
জিল্লুর রহমান নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘গুড়ের দাম বেড়েছে। প্রতি ভাঁড় (গুড় রাখার পাত্র) গুড় ওজনভেদে ৯০০-২৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় গুড়ে ভেজাল বন্ধ হয়েছে। এ হাটের ঝোলাগুড় ও নলেন পাটালি সারাদেশে বিখ্যাত।
পাবনা থেকে আসা ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এবার গুড়ের দাম বেশি কিন্তু সরবরাহ কম। তবে গুড়ে ভেজাল নেই। এছাড়া এ হাটে ব্যাপারীরা বেশ নিরাপত্তা পান। তাই ইচ্ছেমতো গুড় কেনা যায়।’
গুড় কিনতে এসেছেন আব্দুর রউফ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই হাটে ভেজালমুক্ত গুড়-পাটালি পাওয়া যায় বলেই এর সুনাম সারাদেশে। তবে দাম কিছুটা বেশি এই হাটে।’
হাট ঘুরে দেখা যায়, খেজুর গুড়ভর্তি মাটির ভাঁড় ও নলেন গুড়ের পাটালি পুরো হাটজুড়ে সাজানো রয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতারা যাচাই করে দেখছেন। দরদাম ঠিক হলে ওজন করে ভর্তি করা হচ্ছে ট্রাকে। আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি পাঠানোর জন্যও কিনছেন। হাটের প্রবেশ পথের দুই ধারে বসে কৃষকরা কাঠায় করে তাদের বাড়িতে তৈরি পাটালি বিক্রি করছেন। পাটালির দোকান পার হয়ে যত ভেতরে যাওয়া হয়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ততই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় এই হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়ে হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা এমনটাই দাবি করেন।
আরও পড়ুন গুড়ের পায়েস তৈরির সহজ রেসিপিস্থানীয় গুড় ব্যবসায়ী উজ্জ্বল কুমার অধিকারী বলেন, ‘আমাদের গুড়টা সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, পাবনা ও ঢাকাসহ সারাদেশে যায়। বাপ-দাদার মুখে শুনে আসছি, এটা ৩০০ বছরের পুরোনো দেশের সর্ববৃহৎ হাট।’
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের গুড় ব্যবসায়ী বাবুল বলেন, ‘এ হাটে খাঁটি গুড় পাওয়া যায়। এখানকার গুড়ে কোনো ভেজাল নেই। বহু জায়গা থেকে ব্যাপারী আসে এখানে।’
শামসুল মিয়া নামের একজন চাষি বলেন, ‘গতবছর ২৫টি গাছ প্রস্তুত ছিল। এবার সে সংখ্যা কমে ১২টিতে নেমেছে। গাছ থেকে যেটুকু রস পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে গুড় তৈরি করা হচ্ছে।’
বর্তমানে সরোজগঞ্জ গুড়ের হাট পরিচালনার দায়িত্বে আছেন মো. আলাউদ্দিন আলা। তিনি জানান, এই হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গুড় সরবরাহ করা হয়। প্রতি হাটের দিন গড়ে ২৫০ টন বা এর কমবেশি খেজুর গুড় বিক্রি হয়। যার বিক্রয়মূল্য দেড় থেকে দুই কোটি টাকার মতো।
তিনি আরও বলেন, সরোজগঞ্জ হাটে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ গুড়ই এলাকার কৃষক বা গাছিরা বাড়িতে যত্নের সঙ্গে তৈরি করেন। এতে চিনি বা কোনো রাসায়নিক পদার্থ নেই। কিছুটা খয়েরি রঙের হলেও এসব গুড় পুরোটাই খাঁটি।
আরও পড়ুন গুড় খেলে কি সত্যিই পরিষ্কার হয় ফুসফুস?চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জেলায় দুই লাখ ৭২ হাজার খেজুরগাছ রয়েছে। এর অর্ধেকই সদর উপজেলায়। এ জেলা থেকে প্রতি মৌসুমে প্রায় দুই হাজার ৭০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। তবে গাছিদের অভাব এবং নতুন করে গাছ রোপণ না করায় খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে চাহিদা, যারফলে তুলমামূলক উৎপাদন কম হচ্ছে।
বর্তমানে এ জেলায় দুই লাখ ৭২ হাজারের মতো খেজুর গাছ আছে। আর প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। এরসঙ্গে প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষের জীবিকা জড়িত।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, শীত মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে অন্তত ১০-১২ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতিবছর গড়ে দুই হাজার ৭০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। সরোজগঞ্জ খেজুর গুড়ের দেশের প্রধান হাট। এখানে সপ্তাহে প্রায় দুই কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হয়।
তিনি আরও বলেন, নানা কারণে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি না পেলে ভবিষ্যতে গুড়ের উৎপাদন কমে যাবে। এতে ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ হাটের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। খেজুর গাছ রোপণে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এসআর/জিকেএস