সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি হাইকোর্টে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে আবেদন করেছেন তার মা নাসিমা আক্তার।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকালে এই আবেদন করেন তিনি। পরে মামলাটি দ্রুত শুনানির আশ্বাস দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
সিনহার মা নাসিমা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, আমার ছেলে ছিল প্রাণের উৎস। সে যখনই সুযোগ পেয়েছে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণে এগিয়ে গেছে। যেসব নরপিশাচরা আমার ছেলেকে হত্যা করে আমার বুক খালি করেছে, তাদের আমি কোনোদিন ক্ষমা করবোনা, পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে তো বিচার দিয়েই রেখেছি। আমার একমাত্র প্রত্যাশা যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে, সেসব হত্যাকারী মানুষ নামধারী নরকের কীটদের যেন দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। আমি আশায় বুক বেঁধে আছি, সেই দিনের জন্য যেদিন এদের ফাঁসি হবে, আমার মনটা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।
তিনি বলেন, দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রয়েছে, আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিচারের রায় কার্যকর হবে এবং এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে মানুষের জন্য। এতে আর কেউ এভাবে মায়ের বুক খালি করার মতো দুঃসাহস দেখাবে না।
Advertisement
এর আগে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে এসব মামলা করা হয়। টেকনাফ থানায় দায়ের করা দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনে করা মামলায় আসামি করা হয় সিনহার অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে। পরে নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ২০২০ সালের ৫ আগস্ট বাদী হয়ে কক্সবাজার আদালতে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান করে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি।
আরও পড়ুন>>> মেজর সিনহা হত্যার ৩ বছর আজএ মামলাটির পাশাপাশি পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় র্যাবকে। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে আরও সাত আসামিকে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করে র্যাব। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. খাইরুল ইসলাম ওসি প্রদীপসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সেই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে অব্যাহতি দেন আদালত।
এরপর মামলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে স্থানান্তর হয়। ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনে সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
Advertisement
পরে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। ২০২২ এ ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর ওই বছরের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে বাকিদের খালাস দেন বিচারিক আদালত।
যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিরা হলেন- বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
রায়ে খালাস পান- বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ।
বিচারিক আদালতের রায়ের সাত দিনের মাথায় গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার যাবতীয় নথিসহ ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। আর বিচারিক আদালতের রায়ের দুই সপ্তাহের মাথায় খালাসের পাশাপাশি রায় বাতিল ও খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন প্রদীপ-লিয়াকত। পরে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া দণ্ডিতরাও আপিল করেন।
ওসি প্রদীপের আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত ওই সময় বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত এ মামলাটি পেপারবুক শাখায় আছে। কোনো অগ্রগতি নেই। ডেথ রেফারেন্স মামলা যে বেঞ্চেই পাঠানো হোক না কেন, প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে তা গঠন করে দেন প্রধান বিচারপতি। বর্তমানে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলার চারটি নিয়মিত বেঞ্চ রয়েছে। ক্রম অনুসারে ২০১৭ সালের ডেথ রেফারেন্সের মামলার বিচার চলছে এসব বেঞ্চে। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চও গঠন করেন সেই সময়ের প্রধান বিচারপতি। হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স ও পেপারবুক শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন ২০১৮ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলার পেপারবুক তৈরির কাজ চলছে।
বিগত সরকারের সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ বলেছিলেন, ক্রম অনুসারে আসলে মেজর সিনহা হত্যা মামলাটি শুনানিতে উঠতে ২০২৬-২৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ মামলার আাপিল ও ডেথরেফারেন্স প্রধান বিচারপতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির নির্দেশনা প্রদান করলে ভিন্নকথা।
অন্যদিকে, মামলার বাদী মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, ভুক্তভোগী পরিবার হিসেবে চাইবো মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হোক।
এফএইচ/এসআইটি/এএসএম