• বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় • রাজনৈতিক অস্থিরতা• আস্থার সংকট • ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ• নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সংকট • বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা
Advertisement
দেশের অর্থনীতি চাঙা রেখে বেকারত্ব দূর করতে নতুন বিনিয়োগের বিকল্প নেই। ২০২৪ সালে অর্থনীতির বড় আঘাত ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে উৎপাদনমুখী শিল্পে। এটা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে বিনিয়োগকারীদের আস্থায়। ফলে দেশে বিদায়ী বছরে বিনিয়োগ না বেড়ে বরং কমেছে। বিদেশি বিনিয়োগও ঋণাত্মক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, যা গত ৪০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল। উদ্বেগের বিষয় হলো, কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি।
এ ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতি বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। নতুন বছরে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তিত তারা। বিনিয়োগে গতি না এলে দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে না এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২৫ সালেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যদি অস্থিতিশীল থাকে, তবে এটি বিনিয়োগ প্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিনিয়োগকারীরা এমন একটি পরিবেশে বিনিয়োগ করতে চান না যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরকারের সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা থাকে।’
Advertisement
২০২৪ সাল নানান ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গেছে। ২০২৫ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমরা সুযোগ চাই। নতুন ঋণ নয়, বরং যে ঋণ নেওয়া আছে তার সঠিক ব্যবহার করার জন্য সুযোগ প্রয়োজন। সে সুযোগটাই আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার এই মুহূর্তে।- মোহাম্মদ হাতেম
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করবো সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত সময়ে নির্বাচন করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে।’
ব্যবসায়ীরা যা দেখতে চানবাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি এবং এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘২০২৪ সাল নানান ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গেছে। ২০২৫ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমরা সুযোগ চাই। নতুন ঋণ নয়, বরং যে ঋণ নেওয়া আছে তার সঠিক ব্যবহার করার জন্য সুযোগ প্রয়োজন। সে সুযোগটাই আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার এই মুহূর্তে।’
আরও পড়ুন আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য দুটি সুখবর-দুটি অনিশ্চয়তা ২০২৫-এর বর্ষপণ্য হচ্ছে আসবাবপত্র, রপ্তানির অপার সম্ভাবনা ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানিতে হোঁচট‘অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বল অবস্থার কারণে আমরা সমস্যায় পড়ছি, কারণ ব্যাংকগুলো এলসি টাইমলি খুলতে পারছে না। ভালো ব্যবসায়ীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে টাকা পাচ্ছি না। ফলে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।’ বলেন হাতেম।
Advertisement
এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের পাওনা টাকা দ্রুত সময়ে দিতে হবে, যাতে শ্রমিকদের বেতন ও অন্য খরচ মেটাতে পারে। অতীতের মতো ২০২৫ সালেও ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের বড় কিছু সমস্যা হতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সৃষ্টি করতে পারে চ্যালেঞ্জ।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও জ্বালানি সরবরাহ নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রধান শর্ত। দেশে শিল্প-কারখানার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো, যেমন বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অনেক ক্ষেত্রে অপ্রতুল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন কার্যক্রমে বাধাহীনভাবে পরিচালনা করতে পারছে না।’
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মন্দাভাব আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালে যদি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা যেমন মন্দা বা বৈশ্বিক সংকট থাকে, তবে এটি বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলতে পারে।- ফজলে শামীম এহসান
২০২৫ সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিশ্চিত করতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। তা না হলে এটি ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে দাবি এ ব্যবসায়ী নেতার।
রাকিব বলেন, ‘ব্যবসায়িক পরিবেশ ও সরকারের নীতিতে বারবার পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য প্রয়োগ করা নিয়ম-কানুন এবং করের হার যদি জটিল বা অস্থিতিশীল হয়, তবে তা ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনো কিছু জায়গায় কর ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। বিনিয়োগকারীরা এমন পরিবেশে বিনিয়োগ করতে চান না যেখানে কর আদায়ের প্রক্রিয়া জটিল এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে ব্যয় বেড়ে যায়। সুতরাং, বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বাস্তবভিত্তিক ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা ও ব্যাংকখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন। এটা এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকখাতে চরম সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন তারা।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘ব্যাংকখাতের দুর্বল অবস্থার জন্য ঋণ পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। আবার রপ্তানিকারকদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এতে একদিকে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আবার ব্যবসা পরিচালনা করাও কঠিন হচ্ছে। কারণ তারা যথাসময়ে নগদ টাকা পাচ্ছে না প্রয়োজন মতো।’
‘বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মন্দাভাব আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালে যদি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা যেমন মন্দা বা বৈশ্বিক সংকট থাকে, তবে এটি বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলতে পারে।’ বলেন ফজলে শামীম এহসান।
২০২৫ সালে যদি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ আর্থিক প্রণোদনা, কর সুবিধা বা আর্থিক সহায়তা না দেওয়া হয়, তবে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নাও হতে পারেন। দেশি ও বিদেশি বড় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করার আগে লাভজনক সুযোগ খোঁজেন।-মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ২৯ দশমিক ৮১ শতাংশ কমেছে। এই সময়কালে বাংলাদেশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হিসাবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪২৭ মিলিয়ন। এফডিআই ২০২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কমে ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২৫ সালে যদি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ আর্থিক প্রণোদনা, কর সুবিধা বা আর্থিক সহায়তা না দেওয়া হয়, তবে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নাও হতে পারেন। দেশি ও বিদেশি বড় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করার আগে লাভজনক সুযোগ খোঁজেন। তারা ভালো ব্যবসায়িক পরিবেশ চান। সরকারের যথাযথ ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা জরুরি।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বে একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। এটা কাজে লাগিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা সম্ভব বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।
আইএইচও/এএসএ/এএসএম