জাতীয়

‘দমন-পীড়নকারী’ তকমা মুছে ‘জনআস্থা’ ফেরানোর চেষ্টায় পুলিশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয় বাংলাদেশ পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক দমন-নিপীড়নে ছাত্রদের আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। গুলিতে মারা যায় কয়েকশ ছাত্র-জনতা। কোটা আন্দোলন গিয়ে ঠেকে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভের বলি হয়ে প্রাণ যায় অনেক পুলিশ সদস্যের।

Advertisement

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ভেঙে পড়ে বাহিনীটির পুরো চেইন অব কমান্ড। পুলিশ বাহিনী অলিখিতভাবে পরিণত হয় জনগণের ‘শত্রুতে’। ভুক্তভোগীদের কাছে পুলিশ মানেই ট্রমা। গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের হত্যা-নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি দেখে কাজে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় কাজে যোগ দিলেও আস্থা ফিরে পায়নি জনগণের। নতুন বছরে সেই আস্থা ফেরানোয় জোর দেবেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও পুলিশ

গত ২৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার প্রকাশিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে জুলাই-আগস্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ পরিদর্শক, ১১ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই), সাতজন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই), একজন এটিএসআই, একজন নায়েক ও ২১ জন কনস্টেবল রয়েছেন।

সরকার পতনের পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার রোষানলে ডিএমপিসহ পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী ও আওয়ামীপন্থি পুলিশ কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে যান। অনেককে গ্রেফতার, বাধ্যতামূলক অবসর ও বদলি করা হয়। ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কাজে ফিরলেও ডাকাতি, চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধসহ ‘মব’ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখনো সেই ব্যর্থতার বৃত্তেই বন্দি।

Advertisement

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে চায় ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তনের জন্য কমিটি করা হয়েছে। কমিটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন ও এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জনপ্রশাসন এবং স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা সফররাজ হোসেনকে।

আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশি সেবা সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে নগরবাসীর অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য শিগগির অভিযোগ বক্স খোলা হবে। এছাড়া মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সবার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।-ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, বর্তমানে অনেকটাই স্বরূপে ফিরেছে পুলিশ। জনআস্থা ফেরানোর সব চেষ্টাই করা হচ্ছে। বিতর্কিত ও পতিত আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের কাউকে সরানো হয়েছে, মামলায় অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়েছেন। বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে।

দৃশ্যমান পরিবর্তন আসছে, পুনর্গঠনের কাজ চলমান

আইজিপি বাহারুল আলম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে এতগুলো মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন এশিয়ার ইতিহাসেও এমন নজির নেই। এমন একটা ঘটনা ও পরিবর্তনের পরও আমাদের সক্ষমতায় কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব জায়গায় সঠিক লোকটা দিয়ে আমরা শেষ করতে পারিনি। আমাদের পুনর্গঠনের কাজটা চলমান। বদলি হচ্ছে। তদন্ত করতে পারে সেরকম সক্ষম লোকদের বাছাই করে এ কাজে পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া, সারাদেশে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা মেন্টরিং ও মনিটরিং কমিটি করেছি।

Advertisement

গণবদলি কমানোর পরিকল্পনা, তদন্তে মান বাড়াতে উদ্যোগ

আইজিপি বলেন, ঢাকার অপরাধ জগতে নজরদারি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চৌকষ ও অভিজ্ঞ জনবল দরকার। সেখানে গণহারে সিনিয়র থেকে জুনিয়র সব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। যার প্রভাবে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঠেকাতে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশের।

আরও পড়ুনঢাকায় হঠাৎ বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্র, রাত হলেই আতঙ্কজ্যাকেট-আইডি কার্ড না দেখিয়ে আসামি ধরছে না ডিবিশিশুদের এখনো ‘হেলিকপ্টার ট্রমা’, ঘুমাতে দেয় না ‘মিছিল-গুলি’ঢাকায় চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ঠেকাতে নাজেহাল পুলিশ

মনিটরিং ও তদন্তে মান বাড়াতে ঊর্ধ্বতন এবং অভিজ্ঞ, যারা বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে গেছেন তাদেরও আমরা সঙ্গে নিয়ে মনিটরিং টিম করেছি। প্রতি থানায় মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গাইড ও মনিটরিং করার কাজ করবেন। যারা তদন্ত করছেন তাদের দক্ষতা আশানুরূপ নয়। আমার বিশ্বাস তদন্তের মানটা বাড়বে। যারা পালিয়েছেন তাদের লোকেট করা সম্ভব বলে জানান আইজিপি বাহারুল আলম।

আরও উন্নতি দরকার: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে একটু উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আরও উন্নতি হওয়া দরকার। খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যে চলে গেছে তা নয়। এখন যদি বলেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন। জাস্ট সন্তোষজনক, কিন্তু এটা আরও ভালো হওয়া দরকার।

উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলায় জড়ানো সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলার অনেক তথ্য উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। অনেকে জেনেশুনে জীবিত মানুষকে মৃত বলে মিথ্যা মামলা করেন।

পুলিশি কার্যক্রম ফলপ্রসূ করতে হলে এবং সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে হলে শুধু পুলিশই নয়, পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ যেন বলে আমাদের পুলিশ। আমরা সেই পুলিশ হতে চাই।-ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাসান শওকত আলী

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ সদরদপ্তর তদন্ত করছে। গণমাধ্যমে অনেকের নাম পাওয়া গেছে। আমরা নিজেরাও তদন্ত করছি। আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মিথ্যা প্রমাণিত হলে ২১১ ধারা অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হতে হবে সেই বাদীকে।

আস্থা ফেরাতে জনগণের দোরগোড়ায় পুলিশ

জনআস্থা ফেরাতে বিটপুলিশিং চাঙা ও জনগণের দোরগোড়ায় দৌড়াচ্ছে পুলিশ। জনগণের অভিযোগ, সমস্যা শুনতে চেষ্টা করছে পুলিশ। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় মতবিনিময় সভার আয়োজন করছে ডিএমপি নিয়মিত।

এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশি সেবা সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে নগরবাসীর অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য শিগগির অভিযোগ বক্স খোলা হবে। এছাড়া মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সবার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) হাসান শওকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘মহানগরীর প্রতিটি এলাকা নিরাপদ রাখতে পুলিশ দিনরাত কাজ করছে। পুলিশি কার্যক্রম ফলপ্রসূ করতে হলে এবং সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে হলে শুধু পুলিশই নয়, পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ যেন বলে আমাদের পুলিশ। আমরা সেই পুলিশ হতে চাই।’

গণঅভ্যুত্থানে দমন-পীড়নসহ গণহত্যায় জড়িতদের তালিকা হচ্ছে

‘পুলিশ হবে জনতার’ স্লোগান নিয়ে মাঠ পর্যায়ের সাধারণ পুলিশ সদস্য তথা পুরো বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে জনতার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরোধী মত ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার পতনের পর সেই কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে বলে পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

গণঅভ্যুত্থান দমনে হত্যা, গণহত্যা, গ্রেফতার, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ এবং অন্য বাহিনীর সদস্যদের তালিকা তৈরি করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত সংস্থা।

এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধে হওয়া মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায় আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বেশি। কয়েক বছর আগের ঘটনায় ৫ আগস্টের পরে অনেক থানায় মামলা রুজু হয়েছে। ডিএমপি গতিশীলতায় ফিরছে। মামলা হচ্ছে আসামিও গ্রেফতার হচ্ছে। ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিযানে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে তুলনামূলক পরিবর্তন আসছে, উন্নতি হয়েছে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির।’

টিটি/এএসএ/জেআইএম