রাজশাহীতে চলতি মৌসুমে শীত জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে খেজুর গুড় উৎপাদনে ব্যস্ততা বেড়েছে। তীব্র শীত উপেক্ষা করে চলছে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় বাজারজাতকরণ। জমে উঠেছে খেজুর গুড়ের হাট। কৃষি অধিদপ্তর বলছে, রাজশাহীতে চলতি মৌসুমে খেজুর গুড়ে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।
Advertisement
সরেজমিন রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের মধ্যে গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহ করছেন। পরে তা জ্বাল দিয়ে তৈরি করছেন গুড়। সেই গুড় রাজশাহীর বানেশ্বর, বাঘা, ঝলমলিয়াসহ বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বসে বানেশ্বর হাট। আর সপ্তাহে রোববার ও বৃহস্পতিবার বাঘায় হাট বসে। এই দুই হাটেই সবচেয়ে বেশি গুড় বেচাকেনা হয়।
কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি বছর জেলায় খেজুর গুড় থেকেই ১৪১ কোটি টাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে। এই হিসাব শুধু গাছি পর্যায়ের। রাজশাহীর খেজুর গুড় সুস্বাদু বলে গত কয়েক বছরে অনলাইনেও বিক্রি বেড়েছে। সেই গুড়ের দামও কিছুটা বেশি। ফলে সবমিলিয়ে চলতি মৌসুমে গুড়ে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় প্রায় ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি খেজুর গাছ রয়েছে। একটি গাছে বছরে ২০ কেজি রস হয়। তা থেকে ৮ কেজি গুড় হয়। সে হিসাবে মোট গুড়ের উৎপাদন হতে পারে ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪৬ কেজি বা ৮ হাজার ৮৬৪ টন। আর বিক্রি হবে ১৪১ কোটি ২০ লাখ ৪৪ হাজার টাকার। অনলাইনের বাজার ধরলে মোট গুড় বিক্রি হবে ১৫০ কোটি টাকার বেশি।
Advertisement
সম্প্রতি বানেশ্বর, বাঘা, চারঘাটসহ বিভিন্ন হাটে গিয়ে দেখা যায়, ভোর থেকেই জমে উঠেছে খেজুর গুড়ের হাট। হাটগুলোতে পাটালি গুড়, সারা গুড়, বাটি গুড়, খুড়ি গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি খেজুর গুড়ের দাম রাখা হচ্ছে ১২০-১৫০ টাকা।
প্রতি সপ্তাহে ৮০০-১০০০ মণ গুড় আমদানি হয় হাটগুলোতে। রাজশাহীতে গুড় তৈরিতে ব্যাপক সুনাম থাকায় চাহিদাও বেশি। ব্যবসায়ীরা পাইকারিভাবে কিনে এসব গুড় ক্যারেটে সাজিয়ে ট্রাকে করে নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা থেকে গুড় কিনতে এসেছেন রুবেল আহসান। তিনি বলেন, প্রতিহাটে ৪-৫ টন খেজুর গুড় কিনে সেগুলো প্যাকিং করে ঢাকায় পাঠাই। আমার মতো এরকম আরও ১০০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারাও রাজশাহীর বিভিন্ন হাট থেকে গুড় কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠান।
বাঘার আড়ানি এলাকার গাছি জুয়েল রানা জানান, অনেকে খেজুরের রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে দেন। এই গুড়ের দাম কম। এগুলো স্থানীয় হাটে পাইকাররা কিনে নেন। সেগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। কিন্তু ইদানীং অনলাইনের উদ্যোক্তারা আগেই জানিয়ে দেন, টাকা বেশি লাগলেও তারা দেবেন কিন্তু গুড় হতে হবে খাঁটি। এই গুড়ে চিনি মেশানো হয় না। এগুলোর দাম বেশি। গাছিই প্রতিকেজি গুড়ের জন্য ১৭০-১৮০ টাকা নেন।
Advertisement
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ব্যবসায়ী আসিফ ইকবাল অনলাইনে রাজশাহীর আম, খেজুর গুড়সহ নানা কিছুর অর্ডার নেন। তারপর কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেন ক্রেতাদের কাছে।
আসিফ বলেন, দেশব্যাপী রাজশাহীর গুড়ের সুনাম আছে। কিন্তু খরচ ওঠে না বলে বেশিরভাগ গাছিই চিনি মিশিয়ে দেন। এতে স্বাদ কমে যায়। এজন্য অনলাইনের উদ্যোক্তারা অন্তত গাছিদের বেশি দাম দিয়ে খাঁটি গুড় নেন। ফলে বাজারের চেয়ে অনলাইনে গুড়ের দাম কিছুটা বেশি হয়। চলতি মৌসুমে ২৫০- ৩০০ টাকা দরে প্রতিকেজি খেজুর গুড় বিক্রি করছি। তবুও নিরাপদ গুড় পেতে প্রচুর অর্ডার আসে।
বাঘা বাজারের ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক জানান, সপ্তাহে রবি ও বৃহস্পতিবার বাঘায় গুড়ের হাট বসে। শীতের সময় প্রতিহাটে শতাধিক টন গুড় বেচাকেনা হয়। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই গুড় যায়।
তিনি আরও জানান, গতবছর মানভেদে কেজিপ্রতি গুড় ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে এবার সব জিনিসের দাম বাড়ায় গুড়ও বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এরইমধ্যে বাজারে ওঠা গুড় ১২০-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে এবার শুধু বাঘাতেই ৫০-৫৫ কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হবে। ফলে উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টাকা আয় করবেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোছা. উম্মে সালমা জানান, ৬-৭ বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে খেজুর গাছ। একটি গাছ ২৫- ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত রস দেয়।
তিনি আরও জানান, নভেম্বর থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় উৎপাদন শুরু হয়েছে, যা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। চলতি মৌসুমে গুড় উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার মতো গুড় বেচাকেনা হবে বলে আশা করছি।
এসআর/জেআইএম