অর্থনীতি

আগামী ৬ মাসে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বিপিসির

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে জ্বালানি তেল আমদানিতে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানি পণ্য সরবরাহকারীদের সঙ্গে নতুন করে দর কষাকষি হয়েছে। এতে আগামী ছয় মাসে জ্বালানি আমদানির প্রিমিয়ামে প্রায় ৮শ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তির ফলে নতুন নেগোশিয়েশনে জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রিমিয়াম কমানো সম্ভব হয়েছে। নেগোশিয়েশনে অংশ নেওয়া সরকারের সচিব, বিপিসির কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টার কারণে ছয় মাসে ব্যয় সাশ্রয় হবে ৮শ কোটি টাকার মতো।

জানা যায়, আমাদের দেশে বছরে প্রায় ৭০ লাখ টনের মতো পেট্রোলিয়াম জ্বালানির চাহিদা রয়েছে। দেশের চাহিদা পূরণের জন্য পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। এর মধ্যে ১৫ লাখ টন ক্রুড (অপরিশোধিত) অয়েল আমদানির পর ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করে। অন্যদিকে জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহকারী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে জি টু জি এবং আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে বিপিসি।

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি ৫০ লাখ ৬৩ হাজার ৯০৫ মেট্রিক টন পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম জ্বালানি পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৭ মেট্রিক টন ডিজেল, ২ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯০ টন অকটেন, ৫ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৫ টন জেট এ-১, ৬ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৭ টন ফার্নেস অয়েল এবং ১৪ হাজার ৯৮৬ টন মেরিন ফুয়েল। পাশাপাশি একই অর্থবছরে ১৩ লাখ ৭ হাজার ৬৬৮ টন ক্রুড অয়েল আমদানি করে বিপিসি।

Advertisement

আরও পড়ুন

৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসি চট্টগ্রামে বিপিসির প্রধান কার্যালয় ‘নামকাওয়াস্তে’ জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসির বকেয়া ৭ হাজার কোটি, সংকটের আশঙ্কা

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জি টু জির ভিত্তিতে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নির্ধারিত দরের পাঁচদিনের গড় হিসাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সেক্ষেত্রে আমদানি করা জ্বালানি সরবরাহকারীর পয়েন্ট থেকে লোড হওয়ার সময়ের দুদিন আগে এবং দুদিন পরের দিন হিসাব করা হয়। আবার এসব জ্বালানি সরবরাহ করে তেলের দামের সঙ্গে ব্যারেলপ্রতি নির্ধারিত প্রিমিয়াম পান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে (চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর) পরিশোধিত ডিজেলের ক্ষেত্রে ব্যারেলপ্রতি ৮ ডলার ৭৫ সেন্ট প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা আছে। তবে আগামী বছরের প্রথম ছয় মাসের (২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন) জন্য পরিশোধিত ডিজেলের ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়েছে ৫ ডলার ১১ সেন্ট।

পাশাপাশি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত সরবরাহকারীদের কাছ থেকেও আগের চেয়ে কমে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি সংগ্রহ করতে যাচ্ছে বিপিসি। এতে শুধু প্রিমিয়াম খাতে বর্তমানের চেয়ে আগামী ছয় মাসে ৭৯৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন বিপিসির কর্মকর্তারা।

বিপিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি ছয় মাস পর পর দ্বিপক্ষীয় নেগোশিয়েটের মাধ্যমে এ প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়। এসব নেগোশিয়েট মিটিং অনুষ্ঠিত হয় সিঙ্গাপুরে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেষবার ওই প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়। আগামী বছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য পরিশোধিত জ্বালানি সরবরাহের প্রিমিয়াম নির্ধারণে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত নেগোশিয়েট মিটিংয়ে অংশ নিতে গত ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর সফর করে জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। ওই দলে ছিলেন বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান, বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন অ্যান্ড কমার্শিয়াল) মনি লাল দাশ এবং উপব্যবস্থাপক শ্যামল পাল।

Advertisement

ওই নেগোশিয়েট মিটিংয়ে পরিশোধিত জ্বালানি সরবরাহের জন্য আটটি রাষ্ট্রায়ত্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয় বিপিসির। এর মধ্যে রয়েছে ইউনিপ্যাক সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেড- চায়না, পিটি বুমি সিয়াক পুসাকো (বিএসপি)- ইন্দোনেশিয়া, পেট্রোনাস- মালয়েশিয়া, পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং পিটিই লিমিটেড- থাইল্যান্ড, ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেড- ওমান, এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইএনওসি)- সংযুক্ত আরব আমিরাত, পেট্রোচায়না ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গপুর) পিটিই লিমিটেড- চায়না এবং ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল)- ইন্ডিয়া।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে আমাদের নেগোশিয়েট মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার আগামী ছয় মাসের জন্য রিফাইন্ড ডিজেল আমদানিতে প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়েছে ৫ ডলার ১১ সেন্ট হিসেবে। প্রত্যেক আইটেমেই প্রিমিয়াম কমেছে। প্রিমিয়াম কমার কারণে আগামী ছয় মাসে জি টু জি পর্যায়ের আমদানিতেই ৪২৯ কোটি টাকা, পাশাপাশি টেন্ডার অংশেও ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।- বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জি টু জি কিংবা আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে জ্বালানি সংগ্রহ করা হলেও বিগত সরকারের সময়ে সরকারি উচ্চ মহলের বিশেষ করে জ্বালানিমন্ত্রীর প্রভাব থাকতো। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই প্রভাব কেটে গেছে। মিটিংয়ে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। যে কারণে এবারের নেগোশিয়েশন বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। আগে মন্ত্রীর ইশারায় নেগোশিয়েট হতো। কর্মকর্তারা মন্ত্রীর ইশারা বাস্তবায়ন করতেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি বেড়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে প্রিমিয়াম নির্ধারণের নেগোশিয়েট মিটিংয়ে। ফলে আগের চেয়ে অনেক কমেছে প্রিমিয়াম রেট। এতে সরাসরি লাভবান হয়েছে সরকার। তাছাড়া জ্বালানির মূল্য ও প্রিমিয়াম ডলারে পরিশোধ করতে হয়। প্রিমিয়াম রেট কমার কারণে আমাদের ডলারের সাশ্রয়ও হয়েছে।

এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইএনওসি) ‘এমভি এঞ্জেল স্টার’ নামের জাহাজে গত ৬ ডিসেম্বর এক পার্সেলে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৩ ব্যারেল ডিজেল সরবরাহ করে। ওই পার্সেলে (চালান) ডিজেলের গড় দাম নির্ধারিত হয় ব্যারেলপ্রতি ৮৪ ডলার ৫৯ সেন্ট। ওই চালানে ডিজেলের পরিশোধযোগ্য প্রিমিয়াম নির্ধারিত আছে ব্যারেলপ্রতি ৮ ডলার ৭৫ সেন্ট। এতে ওই চালানে প্রিমিয়াম আসে ২১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮৮ ডলার ৭৫ সেন্ট।

আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন একই পরিমাণ একটি পার্সেলে প্রিমিয়াম আসবে ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৬২৪ ডলার ৬ সেন্ট। এতে একই পরিমাণ ডিজেল আমদানিতে বিপিসির সাশ্রয় হবে ৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ ডলার ১২ সেন্ট, যা বাংলাদেশি টাকায় ১০ কোটি ৯০ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৪ টাকা (ডলার ১২০ টাকা হিসাবে)। আগামী ৬ মাসে প্রায় ৭ লাখ টন ক্রুড অয়েল এবং প্রায় ২৬ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করা হবে বলে জানিয়েছে বিপিসি।

বিপিসির চেয়ারম্যান সরকারের সচিব আমিন উল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে আমাদের নেগোশিয়েট মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার আগামী ছয় মাসের জন্য রিফাইন্ড ডিজেল আমদানিতে প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়েছে ৫ ডলার ১১ সেন্ট হিসেবে। প্রত্যেক আইটেমেই প্রিমিয়াম কমেছে। প্রিমিয়াম কমার কারণে আগামী ছয় মাসে জি টু জি পর্যায়ের আমদানিতেই ৪২৯ কোটি টাকা, পাশাপাশি টেন্ডার অংশেও ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস