চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে দেশব্যাপী অর্থনৈতিক শুমারি। চতুর্থ এই অর্থনৈতিক শুমারির মূল তথ্য সংগ্রহের কাজ চলবে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে ৭৩ শতাংশ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ অর্থনৈতিক ইউনিট ব্যয়ের সঠিক তথ্য দিতে চাইলেও আয় ও মূলধনের তথ্য দিতে গড়িমসি করছে।
Advertisement
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) চলমান দেশব্যাপী অর্থনৈতিক শুমারি প্রকল্পে সাভার এলাকায় ফিল্ড ভিজিটে এ চিত্র দেখা গেছে।
সাভারে আশুলিয়ার বিবিএস জোনাল অফিসার আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেক অর্থনৈতিক পরিবার বা ইউনিট আছে তারা আয়ের সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। তবে তাদের যদি ঋণ থাকে, সেই তথ্য দিচ্ছে। এমনকি মূলধনের তথ্যও দিচ্ছে না। আয় কত হয়েছে এটা জিজ্ঞেস করলে বলে ‘কোনো রকম ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। আল্লাহ কোনো রকম চালিয়ে নিচ্ছে। বেচাকেনা নেই।’
কেন তথ্য দিচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা হয়তো ভাবছে নতুন করে করজালে জড়িয়ে পড়ে কি না। আমাদের তথ্য দিতে সবচেয়ে গড়িমসি করছে পোশাক কারখানাগুলো। তারা একবার বলে সকালে এসো, আবার বলে বিকেলে এসো। এভাবে তিন থেকে চারদিন ফিরিয়ে দিচ্ছে।
Advertisement
আরও পড়ুনঅর্থনৈতিক শুমারিতে আসছে ১ কোটি ২২ লাখ আর্থিক ইউনিটের তথ্যএক শুমারিতে শুধু আপ্যায়ন ব্যয় পৌনে ২ কোটি টাকা
সাভার কাঠগড়া এলাকায় স্যানিটারি ও ফিটিংস আইটেম বিক্রি করছে মেসার্স জুবায়েদ এন্টারপ্রাইজ। দোকানে তিনজন কর্মী। তাদের প্রতেক্যের মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা। ফলে বছরে এদের জন্য ব্যয় ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা। অন্যদিকে মাসে দোকান ভাড়া ৩০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় আছে। এছাড়া দোকানে কয়েক কোটি টাকার মালামাল আছে। গড়ে বছরে দোকানের জন্য ব্যয় আছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। অথচ দোকানের মালিকের দাবি, বছরে এই দোকান থেকে ৩ লাখ টাকার বেশি আয় নেই।
১০ লাখ টাকা ব্যয় করে তিন লাখ টাকা আয় করে কীভাবে চলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে দোকানের মালিক জোবায়ের বলেন, ‘আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছে।’
সাভার এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক শুমারিতে প্রায় ৭০টি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন গণনাকারীরা। সারাদেশে ৯৫ হাজার তথ্য সংগ্রহকারী এবারের শুমারির জন্য তথ্য সংগ্রহ করছেন। অর্থনৈতিক ইউনিটগুলো সব তথ্য দিলেও আয়-ব্যয় ও মূলধনের তথ্য দিতে গড়িমসি করছে। এবারই প্রথম ট্যাবের মাধ্যমে ক্যাপি পদ্ধতিতে এই শুমারির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এবারের শুমারিতেই প্রথমবারের মতো দেশে কতজন বিদেশি কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন, তারা কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে কোন পদে কর্মরত আছেন, সেসব তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে। অনলাইনে ব্যবসা ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের তথ্যও খানা থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে।
Advertisement
গণনাকারী আব্দুল হান্নান বাপ্পী জাগো নিউজকে বলেন, কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে সে বিষয়ে আগেই প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিবিএস। সেই ফরমেট অনুযায়ী আমরা তথ্য নিচ্ছি। সব তথ্য দিলেও ব্যয় ও আয়ের তথ্য তারা দিতে চায় না। তখন আমরা নানান ধরনের প্রশ্ন করে তথ্য নিয়ে আসছি। দরকার হয় একাধিকবার আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে যাচ্ছি। সবাই মোটামোটি তথ্য দিচ্ছে। তবে পোশাক কারখানাগুলো ঝামেলা করছে।
দেশের সব অর্থনৈতিক ইউনিটের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রির তথ্যও বাদ যাচ্ছে না। এছাড়া দেশে গড়ে ওঠা অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এবার অর্থনৈতিক শুমারির হিসাবে আসবে।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে প্রতি ১০ বছর পর এমন শুমারি করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। অনেক অর্থনৈতিক ইউনিট আয়ের সঠিক তথ্য দিতে গড়িমসি করবে, এটা ধরে নিয়েই নানা ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে বিবিএস। এজন্য তথ্য সংগ্রহ ও চেকিংয়ের কাজ সমানতালে করা হচ্ছে। যেসব তথ্য সংগ্রহকারী ভুল তথ্য নিয়ে আসছে তাদের পুনরায় খানা বা অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোতে পাঠানো হচ্ছে।
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সুপারভাইজার সেলিনা আক্তার জানান, তিনি ৬ জন তথ্য সংগ্রহকারী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার দলের সদস্যরা মাঠে নেমে জনগণের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন। কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ এবং আন্তরিকতা চোখে পড়ার মতো।
গাজীপুর জেলার শুমারি সমন্বয়কারী মুরশিদা ইয়াসমিন জানান, তাদের দায়িত্বে ৭৭৯ জন তথ্য সংগ্রহকারী আছেন। প্রথম দিকে কিছু সমস্যা হলেও তারা দ্রুত সমাধান করেছেন। সেলিনা আক্তার এবং মুরশিদা ইয়াসমিন জানান, তথ্য সংগ্রহকারীরা মাঠে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলেও তারা একে অপরকে সহযোগিতা করছেন এবং সমস্যা সমাধানে সক্ষম হচ্ছেন।
মাঠ পর্যায়ে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। মুদি দোকানি রহিম মিয়া বলেন, আমার আয় নেই। আমি লসে আছি। আপনি আমাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জেনে কী করবেন? সরকার কি আমাকে সাহায্য করবে?
গণনাকারী নাজমা খাতুন বলেন, মাঠে তথ্য সংগ্রহের সময় প্রায়ই দেখা গেছে লোকেরা আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব দিতে ভয় পাচ্ছে। তবে যখন তাদের বোঝানো হয় যে এ তথ্য আয়কর সংক্রান্ত নয়, তখন তারা সহযোগিতা করছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহকারী ও গণনাকারীরা জনগণকে সঠিকভাবে বোঝান, যাতে তারা সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারে।
প্রকল্প পরিচালক এসএম শাকিল আখতার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি চেকও করছি। শতভাগ নির্ভুল একটি অর্থনৈতিক শুমারি উপহার দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা আছে। যেসব তথ্য সন্দেহ মনে হচ্ছে, সেটি পুনরায় ফেরত পাঠাচ্ছি। তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি আমরা চেকও করছি। আশা করছি প্রযুক্তির সহায়তায় এবার একটি নির্ভুল অর্থনৈতিক শুমারি পাবে দেশবাসী।
এমওএস/এমএইচআর