লোকসানেই চলছে রাজশাহী ওয়াসা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখনো লাভের মুখ দেখতে পারেনি ওয়াসা। সরকারকে প্রতি বছরই দিতে হচ্ছে ভর্তুকি। নতুন করে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে নন-রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লস। নিয়ম অনুযায়ী সিস্টেম লস থাকার কথা ১০ শতাংশ। তবে বর্তমানে সেটি আছে তিনগুণ বেশি। প্রতি বছরই এই সিস্টেম লস দাঁড়াচ্ছে কোটি টাকার ওপরে। গত পাঁচ বছরে সিস্টেম লসের চক্করে পড়ে ওয়াসার রাজস্ব খাতের ৪১ কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা গেছে পানিতেই। তবে ওয়াসা বলছে, ডিটেইলড মিটারড এরিয়া (ডিএমএ) সিস্টেম চালু হলে এটি কমে আসবে।
Advertisement
রাজশাহী ওয়াসার তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন
পদ্মার পানি শোধন করে চাহিদা মেটাবে রাজশাহী ওয়াসা নতুন উদ্যোগ রাজশাহী ওয়াসার, আত্মঘাতী বলছে সুশীল সমাজ২০২০-২১ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৮ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
Advertisement
২০২১-২২ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩১ দশমিক ৪০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৭ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩০ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৬ কোটি ১২ লাখ টাকা।
রাজশাহী ওয়াসা প্রজেক্ট-ফাইল ছবি
সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৯ কোটি ৮৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা।
Advertisement
গত ৫ বছরে সিস্টেম লস বা নন-রেভিনিউ ওয়াটার থেকে রাজশাহী ওয়াসা রাজস্ব হারিয়েছে ৪১ কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
সিস্টেম লস হলে এটা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা দরকার। কিন্তু প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা সিস্টেম লস হবে আর সেটা জনগণের টাকা থেকে যাবে সেটি কাম্য নয়। এজন্য তাদের দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। যাতে মানুষ এটা থেকে বের হয়ে আসে। তবেই এসব চোরাই লাইন ও সিস্টেম লস কমে আসবে। অন্যথায় পানির টাকা পানিতেই পড়তে থাকবে।
এদিকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারানোর পরও থেমে নেই অবৈধ লাইন। রাজশাহীতে বিভিন্ন নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজই হচ্ছে অবৈধ লাইন নিয়ে। নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়ও চলছে লাইন। এক লাইন থেকে চায়ের দোকান, খাবার দোকান, এমনি হোটেল পর্যন্ত চালানো হচ্ছে। সরাসরি এসব লাইন মাটির নিচ থেকে নেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন
শোধন ছাড়াই সুপেয় পানি রাজশাহী ওয়াসার! পদ্মার পানি শোধন করে চাহিদা মেটাবে রাজশাহী ওয়াসারাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় ফুটপাতে দোকান চালান মহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, পাশে একটি ট্যাপ আছে। সেখানে থেকে পাইপের মাধ্যমে আমরা পানি ব্যবহার করি। পানি নিতে কোনো সমস্যা হয় না। যেহেতু এটি সরকারি লাইন; তাই পানির বিলও দিতে হয় না। রাজশাহীর সব খানেই এমন রাস্তার ধারে ট্যাপ দেখতে পাবেন। এসব ট্যাপ থেকে দোকান চালানো হয়।
রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার বড় মসজিদ এলাকায় দেখা গেলো এমন ট্যাপের। সেখানে চায়ের দোকান চালান মো. রঞ্জু। তিনি বলেন, দোকান তো পানি এনে করতে হয়। মন্দিরের ওখানে একটি ট্যাপ আছে; সেখান থেকেই পানি নিয়ে দোকান চালাই। কোনো বিল দিতে হয় না।
রাজশাহী ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সোহেল রানা জানান, রাজশাহী ওয়াসার পানি পরিমাপে কোনো যন্ত্র নেই। তবে একটি সঠিক পরিমাপের মাধ্যমে নন-রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লস ধরা হয়। মূলত অবৈধ লাইন, নির্মাণকাজে অবৈধ লাইন, লাইন ফেটে যাওয়া, লিকেজসহ নানান কারণে এসব হয়। এগুলোর পরিমাণ দিন দিন কমছে। তবে স্ট্যান্ডার্ড মাপ হলো ১০ শতাংশ।
বিভিন্ন কারণে আমাদের বৈধ গ্রাহক হতে পারবেন না। অনেকে রাস্তার কাজ করছে, যারা ডেভেলপার সবাই এগুলো ব্যবহার করছে। পানির লাইন নেওয়া এত সহজ যে, যে কোনো একটি মিস্ত্রিকে বললে তিনি এই লাইন দিয়ে দিতে পারেন। এটা দৃষ্টিগোচরে এনে বন্ধ করতে না পারা পর্যন্ত আমাদের সিস্টেম লস হচ্ছে।
রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন বলেন, সিস্টেম লস নানান কারণে হয়। পানি তো উৎপাদন করতেই হচ্ছে। আমরা পাম্প ১৬ ঘণ্টা না চালালে পানির প্রেসার হয় না। আধুনিক সিস্টেমে দিতে না পারার কারণে মেন্যুয়ালি করতে হচ্ছে। মূলত পাম্প চালু না করলে পানির গ্রাহকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ফলে আমাদের সিস্টেম লস হচ্ছে।
আরও পড়ুন
১৫ বছরে হানিফ-আতার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে রকেটের গতিতে চার কুমিরের পেটে হাসপাতালের ১৫ কোটি টাকাতিনি বলেন, নানান কারণে আমাদের বৈধ গ্রাহক হতে পারবেন না। অনেকে রাস্তার কাজ করছে, যারা ডেভেলপার সবাই এগুলো ব্যবহার করছে। পানির লাইন নেওয়া এত সহজ যে, যে কোনো একটি মিস্ত্রিকে বললে তিনি এই লাইন দিয়ে দিতে পারেন। এটা দৃষ্টিগোচরে এনে বন্ধ করতে না পারা পর্যন্ত আমাদের সিস্টেম লস হচ্ছে।
পানি শোধনের কর্মযজ্ঞ-ফাইল ছবি
তিনি আরও বলেন, আমরা অলরেডি ডিটেইলড মিটারড এরিয়া (ডিএমএ) সিস্টেম চালুর জন্য মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষা করেছি। আমাদের গোদাগাড়ী প্রজেক্টের সঙ্গে মার্জ করে এটি ডিপিপির মাধ্যমে এটি করা হবে। এটি হলে সিস্টেম লস কমে যাবে। এটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখন পর্যন্ত সিস্টেম লস নিয়ে কাগজে কলমেই আছি, অভিযানও পরিচালনা করছি। কিন্তু খুঁজে বের করতে পারছি না। অগোচরে থেকে যাচ্ছে অনেক কিছু। এ কারণে সিস্টেম লস হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলা সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, সিস্টেম লস হলে এটা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা দরকার। কিন্তু প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা সিস্টেম লস হবে আর সেটা জনগণের টাকা থেকে যাবে সেটি কাম্য নয়। এজন্য তাদের দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। যাতে মানুষ এটা থেকে বের হয়ে আসে। তবেই এসব চোরাই লাইন ও সিস্টেম লস কমে আসবে। অন্যথায় পানির টাকা পানিতেই পড়তে থাকবে।
এসএইচ/এসএইচএস/এমএস