তরুর বয়স যখন দশ; তখনই পরলোকের টিকিট কাটেন তরুর বাবা অনিলবাবু। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তরুর মা রূপাঞ্জনা সারাক্ষণ ছায়া হয়ে থেকেছেন তার মাথার ওপর। যদিও তিনি তরুর নিজের মা নন। বাবার অভাব, অনুপস্থিতি কখনোই বুঝতে পারেনি সে। বুকের সব ভালোবাসা দিয়ে মা তাকে আগলে রেখেছেন। সেই প্রাণাধিক তরুর আজ বিয়ে।
Advertisement
বিয়েবাড়িতে আসা আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সব অতিথি তরুর শ্বশুরবাড়ির ধন্য ধন্য করছে। কেউ বলছে, ‘বড্ড সংস্কারি পরিবার পেয়েছে তরু’। একজন বলল, ‘তরুর কপালটা বড্ড চওড়া’। আবার শোনা গেলো, ‘যেমন লক্ষ্মীমন্ত তরু; তেমনই তার জামাই’। ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিয়ের সব কাজ নিখুঁতভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। সব আচার, রীতি-নীতি একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করা হয়েছে। এখন শুধু কনকাঞ্জলিটাই বাকি। তরুর মা রূপাঞ্জনার চোখে জল। অন্যদিকে মুখ করে আঁচল পেতে আছে সে। তরু কান্নায় ভেঙে পড়ে। চালগুলো এক এক করে হাত থেকে পড়ে যায়। তরুর দাদা তপু। তরুকে সামলাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে যায় সেও। অরুণাভ তখন এগিয়ে আসে। তরুর হাত দুটো খুব জোরে চেপে ধরে। তার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। মুহূর্তেই সবার চোখ যেন কপালে উঠে যায়। নতুন জামাইয়ের এ কী আচরণ! উপস্থিত সবাই সমালোচনা করতে শুরু করেন। তরুর মা ভীষণ ভয় পেয়ে যান; মেয়েকে কোনো নরকখানায় পাঠালো না তো সে?
আরও পড়ুন
Advertisement
অরুণাভ হঠাৎ বলতে লাগল, ‘কার ঋণ শোধ করবে তরু? এই যে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষটা, উনি কি শুধুই তোমার মা? দু’মুঠো চাল ছিটালেই মায়ের ঋণ শোধ হয়ে যায়? মায়েদের ঋণ এত সামান্য, ঠুনকো? মা কোনো দেবীর চেয়ে কম নয়। আর দেবীর পায়ে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাও যদি অর্পণ করা হয়, তাও কি তার ঋণ শোধ হয়?’
অরুণাভ কিছুতেই তরুকে কনকাঞ্জলির রীতিটা পালন করতে দিলো না। তার কথা, ‘আমি চাই আমার স্ত্রী আজন্মের ঋণ নিয়েই তার স্বামীর গৃহে পা রাখুক। যেন এই ঋণের টানেই সে বারবার ছুটে আসতে পারে।’
প্রথমে সবাই ভুল বুঝলেও পরে ঠিকই অরুণাভের প্রশংসায় ডুবে যায়। আর তরু নির্বাক হয়ে যায় এক অপার মুগ্ধতায়।
খানিকটা দূরে চেয়ারে বসে আছেন তরুর ঠাকুমা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন রূপাঞ্জনাকে। তার চোখে অনুশোচনার জল ছলছল করছে। ছেলেবউ আর নাতনিকে কখনো মেনে নিতে না পারার ভুলটা আপন মনে স্বীকার করে নিচ্ছেন দূরে বসেই। মনে মনে বলছেন, ‘সত্যিই তো, অন্যের ফেলে যাওয়া সন্তানকে যে নিজের ভাবে, নিজের গর্ভের সুখ বিসর্জন দিয়ে বুকের সব মমতা দিয়ে যে তাকে আগলে রাখে, সে সাক্ষাৎ দেবীই হয়!’
Advertisement
এই সামান্য কথাটা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছেন বলে দু’ফোঁটা জল তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। তবু শেষমেশ বুঝতে পেরেছেন, এই আনন্দে চোখের জল দূরে বসেই আঁচলে মুছে নেন তিনি।
এসইউ/এমএস