কৃষি ও প্রকৃতি

ভেষজ পদ্ধতি ও ভার্মি কম্পোস্টে বদলে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চল

উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন জেলায় রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি চাষ করা হচ্ছে। বগুড়াসহ রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা মিলেছে বিষমুক্ত এসব সবজি ক্ষেতের। কৃষকেরাও এ চাষের মাধ্যমে শুরু করেছেন নতুন কৃষি আন্দোলন। তাদের ভাষ্য, যে খাবার বিপদ ডেকে আনে; তা আমরা উৎপদন করবো না। তাই বিষমুক্ত সবজি চাষের এ উদ্যোগ। এতে একদিকে জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয়েছে; অন্যদিকে বাজারে তাদের উৎপাদিত সবজির চাহিদাও বেড়েছে।

Advertisement

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর ইউনিয়নের কামারপাড়া ও জৈন্তপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, কৃষকেরা বিষমুক্ত সবজি চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দূরে সরিয়ে ভেষজ পদ্ধতি এবং ভার্মি কম্পোস্ট প্রয়োগ করে চাষাবাদ করছেন। জমি থেকে বাজার পর্যন্ত সর্বত্রই তাদের এ উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে।

১৮ ডিসেম্বর সকালে সূর্যের আলোয় টমেটো ক্ষেতের পাশে বসে কাজ করছেন কৃষক আব্দুল মান্নান (৫৮)। জমিতে এক ধরনের জৈব সার ছিটিয়ে দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘আগে রাসায়নিক ব্যবহার করতাম। ফলন ভালো হলেও জমি শক্ত হয়ে মাটির প্রাণশক্তি হারিয়ে যেত। এখন কেঁচো সার আর ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করছি। মাটির উর্বরতা আবার ফিরে এসেছে। ফসলের গুণমানও বেড়েছে। ক্ষেতের একপাশে গাছের ডালে ঝুলছে নিমপাতা ও পিতরাজ দিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক কীটনাশকের বোতল। এ ওষুধ জমিতে স্প্রে করলে পোকামাকড় দূরে থাকে কিন্তু গাছের কোনো ক্ষতি হয় না।’

কামারপাড়া গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশে সিমেন্টের তৈরি রিং আছে। এগুলোতে কেঁচো, গোবর ও খড়কুটো মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট। কৃষক আব্দুল মজিদ (৫৫) তার বাড়ির পাশের রিঙের কাছে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘গোবর আর কিছু জৈব উপাদান ব্যবহার করে আমরা কেঁচো সার তৈরি করি। এ সার জমিতে দিলে ফলন অনেক ভালো হয়।’

Advertisement

মনোয়ারা বেগম (৩৮) নামের আরেক নারী কৃষক বলেন, ‘আমরা নিজেরাই এ সার তৈরি করি। এটা শুধু খরচ কমায় না, জমির গুণগত মানও বাড়ায়। আগে যে জমিতে ১০০ কেজি ফসল হতো; এখন সেখানে ১২০ কেজি হচ্ছে।’

গ্রামের তরুণ কৃষক কামরুল হাসান শোভন (২৮) দেখালেন কীভাবে ভেষজ উপাদান দিয়ে কীটনাশক তৈরি করেন। তিনি বলেন, ‘নিমপাতা, বিষকাটালি আর থানকুনির মতো গাছপালা মেশানো নির্যাস সবজির জমিতে স্প্রে করলে পোকামাকড় দূরে থাকে। এতে গাছ সুস্থ থাকে এবং ফলন বেশি হয়। কামারপাড়া গ্রামটি মরিচ চাষের জন্য বিখ্যাত।’

১০ শতাংশ জমির মরিচ চাষের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে জমি চাষ থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচ থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত একটি জমিতে খরচ হয় সাড়ে ৬ হাজার টাকা। এ জমি থেকে ফলন পাওয়া যায় ৪৮-৫০ মণ। ৩০০ টাকা প্রতি মণ দরে বিক্রি করলেও এ মরিচের দাম পড়ে ১৫ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে সাড়ে ১১ হাজার টাকা।’

আরও পড়ুন

Advertisement

সুনীলের সুগন্ধি মরিচ, বছরে গড়ে আয় ৮ লাখ সিরাজগঞ্জে ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ

অন্যদিকে অর্গানিক পদ্ধতিতে জমিটি চাষ করলে খরচ পড়ে ৩ ভাগের ১ ভাগ। এ পদ্ধতিতে জমি তৈরির সময় গোবর সার দিতে হয়। এরপর সেচ দেওয়ার আগে দিতে হয় ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো ও গোবর দিয়ে তৈরি স্থানীয় সার) ১৫-২০ কেজি। এরপর পোকা মারার জন্য তারা ব্যবহার করেন ভেষজ ওষুধ। নিমপাতা, বিষকাটালি, পিতরাজ, থানকুনি, ধুতুরা, ভেরেন্ডা দিয়ে তারা তৈরি করেন একটি নির্যাস, যা প্রতি লিটার পানিতে মাত্র ৫০ গ্রাম মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করলে ফসলে কোনো পোকামাকড় থাকে না। গাছ বাঁচে বেশি দিন। ফলন হয় অনেক বেশি। ফসলের চেহারা হয় চকচকে এবং বিষমুক্ত। এ পদ্ধতিতে ১০ শতাংশ জমি চাষে খরচ পড়ে মাত্র ২ হাজার টাকা। ফসল পাওয়া যায় ৫৫-৬০ মণ। একইভাবে ৩০০ টাকা মণ হিসেবে বিক্রি করে খরচ বাদ দিয়েও তাদের লাভ হয় ১৬ হাজার টাকা। বিষমুক্ত সবজি ক্রেতাদের কাছে বেশি জনপ্রিয় হওয়ায় বাজারে বিক্রির জন্য কোনো সমস্যা হয় না। যে কারণে এ গ্রামের বিষমুক্ত সবজি এখন আশপাশের বাজারে খুব গুরুত্ব পাচ্ছে।

পাইকার সালাম সওদাগর (৫০) বলেন, ‘আমি এ গ্রাম থেকে নিয়মিত সবজি কিনি। ঢাকার বাজারে এ সবজি ভালো দামে বিক্রি হয়। ক্রেতারা বিষমুক্ত জিনিস খুঁজছেন, তাই এর দাম একটু বেশি হলেও কোনো অসুবিধা হয় না। রাসায়নিক সার দিয়ে উৎপাদিত সবজি অনেক সময় ঢাকা পৌঁছানোর আগেই পচে যেত। বিষমুক্ত সবজি বেশি সময় টিকে থাকে। তাই এটি ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয়।’

পাশের আরডিএ বাজারে সবজি কিনতে আসা চাকরিজীবী মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমি বিষমুক্ত সবজি কিনে নিজের এবং পরিবারের স্বাস্থ্যরক্ষার চেষ্টা করছি। এসব সবজি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থমুক্ত, যে কারণে আমরা নিশ্চিন্তে এগুলো খেতে পারি। আমরা যারা শহরের মানুষ, যারা স্বাস্থ্য সচেতন; তাদের কাছে এ বিষমুক্ত সবজি এখন অনেক আকর্ষণীয়।’

গ্রামের কৃষক শুকুর আলী (৬০) বলেন, ‘আগে মৌসুমে চাষাবাদের জন্য অনেক ঋণ করতে হতো। রাসায়নিক কিনতে খরচ হতো অনেক বেশি। এখন নিজেরাই সার আর কীটনাশক তৈরি করি। খরচ কমে যাওয়ায় লাভও বেশি হচ্ছে। আমার দুই ছেলে পড়ালেখা করছে। আগে এটা সম্ভব ছিল না।’

এদিকে কামারপাড়ায় নারীরা শুধু পরিবারের কাজে সীমাবদ্ধ নন। নারী কৃষক মনিরা খাতুন (৪২) বলেন, ‘আমরা নিজেরা জমিতে কাজ করি। পাশাপাশি বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করি। বিষমুক্ত সবজি বিক্রি করে যা আয় হয়; তা দিয়ে সংসারের খরচ চালাই।’

কৃষকদের নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সহযোগিতা করে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি কীভাবে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করতে হয় এবং ভেষজ কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তাদের এ উদ্যোগ সারাদেশের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠছে।’ তিনি এসব বিষমুক্ত সবজি সাধারণ ক্রেতার নাগালে পৌঁছাতে আলাদা বাজার ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা কামনা করেন।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতলুবুর রহমান বলেন, ‘বিষমুক্ত চাষাবাদে শুধু কৃষকেরই লাভ হচ্ছে না, ক্রেতারাও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাচ্ছেন। আমরা এ পদ্ধতি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। এতে কৃষক এবং ভোক্তা দু’পক্ষই লাভবান হবেন।’

আরও পড়ুন

খৈয়াছড়ার মিষ্টি ক্ষিরা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায় শীতকালীন সবজিতে সম্ভাবনা দেখছেন কৃষকেরা যেভাবে শুরু

বিষমুক্ত চাষের এ যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের দিকে। কামারপাড়া গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমানের চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কীটনাশক স্প্রে করার কারণে। তার এ দুর্ঘটনা ছিল একটি শিক্ষা, যা পুরো গ্রামকে সচেতন করেছিল। এরপর থেকে কামারপাড়া গ্রামসহ আশপাশের অন্য গ্রামেও এ বিষমুক্ত চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। কৃষকেরা সিদ্ধান্ত নেন, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে শুধু ভেষজ উপাদান দিয়ে সবজি চাষ করা হবে।

তাদের এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর (ফসলের ডাক্তার) রোস্তম আলী। শুরুতে কামারপাড়া ও জৈন্তবাড়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এ উদ্যোগ। এরপর আশেপাশের গ্রাম বৃ-কুষ্টিয়া, ফুলকোট, বিলকেশপাতা, বিহিগ্রাম, দহিকান্দি, বড়পাথার, চুপিনগর, বোহাইল, দুসকুলা, মোস্তাইল, খলিশাকান্দি, দুর্গাপুর, শিবপুর, রামনগর, জোয়ানপুর, রাধানগর, গাড়িদহ, সোনাইদীঘি বিষমুক্ত চাষের প্রভাবে বদলে গেছে। স্থানীয় কৃষকেরা একে অপরকে অনুপ্রাণিত করছেন। তারা এখন স্বেচ্ছায় একে অপরকে পরামর্শ দিচ্ছেন।

অন্য জেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে

রংপুর জেলার পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, কাউনিয়া উপজেলার কৃষকেরাও এখন বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন। রংপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা কীটনাশক ছাড়া শাক-সবজি চাষ করছেন। কৃষক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা আগে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতাম কিন্তু এখন জৈব সার ব্যবহার করি। গাছের প্রতি যত্নশীল হই। এ নতুন পদ্ধতিতে চাষ করলে ফসলের গুণগত মান অনেক ভালো হয়। পরিবেশও দূষিত হয় না। কৃষি বিভাগও তাদের সহায়তা দিয়ে আসছে, যা চাষাবাদে সহায়ক হচ্ছে।’

দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর, বিরল, নবাবগঞ্জ এলাকায় কৃষকেরা কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে সবজি চাষ করছেন। এখানে তারা ভার্মি কম্পোস্ট, গোবর সার এবং প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে জমির উর্বরতা বাড়াচ্ছেন। ফলনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাকিমপুরের কৃষক সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষ করলে জমি আরও সুস্থ থাকে এবং ফসলও ভালো হয়।’

এদিকে পঞ্চগড় জেলার কিছু অঞ্চলে কৃষকেরা বায়োফার্টিলাইজারের ব্যবহার করেছেন, যা পরিবেশবান্ধব এবং জমির উর্বরতা বজায় রাখে। স্থানীয় কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কিছু প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সবজি চাষ করি। এতে খরচ কম, ফলনও ভালো হয়। তাদের এ পদ্ধতি বর্তমানে অন্য কৃষকের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দিন দিন এর ব্যবহার বাড়ছে।’

এসইউ/এমএস