‘বাংলাদেশ’ শব্দটি এসেছে মূলত বঙ্গ বা বঙ্গাল থেকে। প্রাচীনকাল থেকে ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি মৌর্য, গুপ্ত ও পাল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। মধ্যযুগে, বিশেষ করে সুলতানি আমলে ‘বাংলা’ শব্দটি পুরো অঞ্চলের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। মুঘল আমলে ‘সুবা বাংলা’ নামে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল ছিল। কিন্তু বঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গ, পূর্ব বাংলা এবং তারপর কীভাবে বাংলাদেশ হলো?
Advertisement
‘বঙ্গ’ শব্দটি চীনা তিব্বতীয় শব্দ এবং শব্দটির অংশের মূল অর্থ জলাভূমি। অর্থাৎ যারা জলাভূমিতে বাস করে তারা বঙ্গ, তাদের আবাসভূমি বঙ্গদেশ। বঙ্গের অবস্থান তথা সীমারেখা সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কোনো কোনো গ্রন্থে ব্রহ্মপুত্র থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে ‘বঙ্গ’ বলা হয়েছে। সম্ভবত সুন্দরবনের পূর্বপ্রান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহিত স্রোতধারার মধ্যবর্তী ভূ-ভাগই ছিল বঙ্গ। এ থেকে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ঢাকা, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চল বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৯৪৭ সালের আগে বাঙালির বসবাসের দেশ বা অঞ্চল ‘বঙ্গদেশ’ নামে পরিচিত ছিল। বঙ্গদেশকে ইংরেজরা বলতো ‘বেঙ্গল’। এ নামটি তারা পেয়েছিল পর্তুগিজদের কাছ থেকে। পর্তুগিজরা বলতো ‘বেঙ্গালা’।
প্রাচীনকালে কখনো বঙ্গ, কখনো গৌড় নামে বাংলা পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গাল’ নাম ধারণ করে আকবরের রাজত্বকালে ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলা তখন মোগল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণত হয়। মোগল শাসকগণ আরো ২০০ বছর ‘বাংলা’ শাসন করেন। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। ১৮৫৭ সালে তা সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়। মোগলদের দেয়া নামের আদলে পর্তুগিজরা (Bangal) নামে অভিহিত করে। ইংরেজরা এর নাম দেয় বেঙ্গল (Bengal)। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সরকারের অধীনে ভারতে যে ১২টি শাসন বিভাগ ছিল, তার মধ্যে বাংলা ছিল। এ সময় যুক্তপ্রদেশ বিহার ও উড়িষ্যা এবং আসাম বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। পূর্ববঙ্গ পড়ে পাকিস্তানের মধ্যে, আর পশ্চিমবঙ্গ পড়ে ভারতের মধ্যে।
Advertisement
তবে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিলেন তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। একটি মত হলো এই যে, বাংলাদেশ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়। তার বিখ্যাত দেশপ্রেমমূলক গান ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’ লেখা হয় এই বছর। যদিও এর আগেই রবীন্দ্রনাথ তার গদ্যে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা অনেকবার ব্যবহার করেছেন। তখন তিনি বাংলাদেশ বলতে অভিন্ন বাংলাকে বুঝিয়েছিলেন, যখনও বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ভূখণ্ড হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশ বলতে তখন একটি আলাদা রাষ্ট্র নয়—যার নিজস্ব মানচিত্র ও পতাকা আছে। বরং রবীন্দ্রনাথ যে বাংলাদেশ লিখেছেন সেটি তখন ভারতবর্ষের একটি অংশ। এমনকি তখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রও হয়নি। বাংলাদেশ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বিশাল জনপদকে। যে জনপদ পরবর্তীকালে দুই দেশে ভাগ হয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা করেন বঙ্গভঙ্গের সময়, যখন ব্রিটিশরা বাংলাকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছিল। গানটি তৎকালীন বাঙালিদের মধ্যে দেশপ্রেম ও ঐক্যের বোধ জাগ্রত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই সময়ে তিনি লেখেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’—যা এখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
রবীন্দ্রনাথের আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাতেও ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি এসেছে ‘বঙ্গদেশ’ হিসেবে।
ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কুমুদীন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘বাংলাদেশের কথা’ নামে বইতে প্রথম বাংলাদেশ শব্দটি ব্যবহার করা হয় বলেও কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু এর সঠিক প্রকাশ সাল নিয়ে দ্বিমত আছে।
Advertisement
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাসের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) হয় এই সরকারের শপথ গ্রহণ। মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়, সে সময় দেশটির সাংবিধানিক নাম হয় ‘বাংলাদেশ’।
১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ দাশও ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা করে তিনি লিখেছেন: ‘আজকালকার বাংলাদেশের নবীন লেখকদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে, তাদের মাথার ওপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মতো আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে।’
জীবনানন্দ এই চিঠিটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির উত্তরে। চিঠিটি লেখা হয় কলকাতা শহরের ৬৬ হ্যারিসন রোডে, অর্থাৎ প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে বসে। জীবনানন্দ তখন বেকার। আগের বছরই সিটি কলেজ থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বরিশাল-কলকাতা যাওয়া-আসা করেন। আর কলকাতায় গেলে অবস্থান করেন এই প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে।
ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের গীতিগ্রন্থ ‘বনগীতি’তে স্বদেশি গানে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি আছে এভাবে:
‘নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মমচির-মনোরম চির মধুর।’
এই গীতিকবিতায় তিনি বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন এভাবে:
‘বুকে নিরবধি বহে শত নদীচরণে জলধির বাজে নূপুরশিয়রে গিরি-রাজ হিমালয় প্রহরী,আশিস-মেঘ বারি সদা তার পড়ে ঝরি,যেন উমার চেয়ে এ আদরিণী মেয়ে,ওড়ে আকাশ ছেয়ে মেঘ-চিকুর।’
বাংলার ছয়টি ঋতুর বর্ণনাও আছে এই কবিতায়:‘গ্রীষ্মে নাচে বামা কাল-বোশেখি ঝড়ে,সহসা বরষাতে কাঁদিয়া ভেঙে পড়ে,শরতে হেসে চলে শেফালিকা-তলেরগাহিয়া আগমনি- গীতি বিধুর।হরিত অঞ্চল হেমন্তে দুলায়েফেরে সে মাঠে মাঠে শিশির-ভেজা পায়ে,শীতের অলস বেলা পাতা ঝরার খেলাফাগুনে পরে সাজ ফুল-বধূর॥এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে,যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে,এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখেঘুমাব এই বুকে স্বপ্নাতুর।’
অর্থাৎ বাংলাদেশের একটি মোটামুটি পরিষ্কার রূপ তিনি এখানে দিয়েছেন ১৯৩২ সালে যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মই হয়নি এবং যখন বাংলাদেশ নামে পরিচিত এই ভূখণ্ডের নাম ছিল পূর্ববাংলা।
মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে প্রকাশিত সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাভাস’ কাব্যগ্রন্থের ‘দুর্মর’ শিরোনামের কবিতাতেও ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি এসেছে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো সুকান্ত লেখেন ১৯৩৭ সালের দিকে। কবিতাটি শুরু হয় এভাবে- ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ/কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে’।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের প্রায় এক দশক পরে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখে। এর মধ্যে বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলে এবং এরপর ষাটের দশকে স্বাধিকারের দাবিতে এই ভূখণ্ডে আন্দোলন দানা বাঁধলে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকে।
১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, তারা পূর্ব বাংলার স্থলে ‘‘পূর্ব পাকিস্তান’’ বসাতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়ে এসেছি যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের পূর্ববাংলা ব্যবহার করতে হবে। বাংলা শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য...। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নিবে কি না সেজন্য গণভোট নিতে হবে। (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ০৮ ডিসেম্বর ২০২১)।
বস্তুত এই ভূখণ্ডের নাম ‘বাংলাদেশ’ করার দাবি উঠতে শুরু করে ১৯৬৫ সাল থেকে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময় জন্ম নেয় ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’ নামের নতুন একটি সংগঠন; সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত এই সংগঠনের একটি ইশতেহারে বলা হয়, ‘আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ’। ইশতেহার শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ দিয়ে।
১৯৬৯-এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত ‘তোমার দেশ আমার দেশ; বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- এমন বিভিন্ন স্লোগানে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ঘুরেফিরে এসেছে।
পরে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ’। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করলে তাতে সবাই একবাক্যে সায় দেন। এই নাম দেয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে ‘বাংলা’, এরপর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দেশ। এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়। (বিবিসি বাংলা, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৮)।
সত্তরের নির্বাচন ঘিরে এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা দাবি করার পাশাপাশি এর নাম ‘বাংলাদেশ’ করার দাবি আরও তীব্র হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাসের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) হয় এই সরকারের শপথ গ্রহণ। মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়, সে সময় দেশটির সাংবিধানিক নাম হয় ‘বাংলাদেশ’।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/জেআইএম