মতামত

রপ্তানি বহুমুখীকরণ: আমাদের চ্যালেঞ্জ

টেকসই রপ্তানি বাণিজ্য এবং রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রাখতে আমাদের রপ্তানি তালিকায় পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য তৈরি পোশাকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। অন্য প্রধান রপ্তানি পণ্য চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়। অ্যাপারেল খাত ব্যতিরেকে অন্য খাতের অবদান মাত্র ১৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। বছরের পর বছর ধরে দেশের নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং শিল্প বিশেষজ্ঞরা টেকসই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিশ্চিত করার জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণের ওপর ক্রমাগতভাবে জোর দিয়েছেন। তবে বহুল আলোচিত এই ইস্যুতে এখনো তেমন অগ্রগতি হয়নি। রপ্তানি বহুমুখীকরণ না হওয়ার কারণগুলো সুস্পষ্ট এবং আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিয়েছি।

Advertisement

১. একক খাতের ওপর নির্ভরতা: বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য মূলত পোশাক খাতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ। রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আয় অর্জনকারী খাতটি সরকারের কাছ থেকে বহুবিধ সহায়তা পেয়ে আসছে, এর মধ্যে নগদ প্রণোদনা, বন্ড সুবিধা, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ এবং নীতিগত সহায়তা উল্লেখযোগ্য। তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের কম উৎপাদন ব্যয় এবং বড় ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বিধায় অন্য খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের পথে এ খাত বাধার সৃষ্টি করে। গত পাঁচ বছরে পোশাক খাতের অবদান নিম্নরূপ:

 

অর্থবছর

রপ্তানি আয় (মিলিয়ন ডলার)

Advertisement

রপ্তানি শেয়ার (%)

২০১৯-২০

২৭৯৪৯.১৯

৮৩.০০

Advertisement

২০২০-২১

৩১৪৫৬.৭৩

৮১.১৬

২০২১-২২

৪২৬১৩.১৫

৮১.৮২

২০২২-২৩

৩৮১৪২.১

৮২.১৫

২০২৩-২৪

৩৬১৫১.৩১

৮১.২৯

২. রপ্তানি গন্তব্যের দুর্বলতা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশি পণ্যের দুটি প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। এককভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৃহত্তম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার। এই দুটি রপ্তানি গন্তব্যে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির যথাক্রমে ৪৪ শতাংশ এবং ১৭ শতাংশ সংঘটিত হয় এবং অন্য গন্তব্যে রপ্তানি হয় ৩৯ দশমিক ০২ শতাংশ। নিম্নলিখিত গ্রাফের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্টীকরণ করা যায়:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ’র ওপর বাংলাদেশের অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের রপ্তানিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। এই অতিরিক্ত নির্ভরতা হ্রাস করার জন্য আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং উত্তর আমেরিকাসহ অন্য অঞ্চলের মতো সম্ভাবনাময় বাজারগুলো অন্বেষণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ইতোমধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বাজার বহুমুখীকরণ এবং বাজার উন্নয়ন কৌশলের অধীন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এর মধ্যে পণ্যভিত্তিক পলিসি পেপার প্রণয়ন, সম্ভাবনাময় বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আইকনিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণ এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাণিজ্য প্রতিনিধি দল প্রেরণ উল্লেখযোগ্য।

৩. সম্ভাব্য খাতগুলোর তৈরি পোশাক খাতের মতো সহায়তা না পাওয়া : দেশের অন্য সম্ভাব্য পণ্য খাত, যেমন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হস্তশিল্প, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি ও আইটি এনাবল্ড সার্ভিসেস এবং হালকা প্রকৌশল পণ্য, তৈরি পোশাক খাতের মতো একই ধরনের সহায়তা পাচ্ছে না। এই সমস্যাগুলো বহুবার আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নের অগ্রগতি খুব বেশি চোখে পড়েনি। প্রতিযোগী দেশগুলোর কর্মপদ্ধতি বিবেচনা করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে তাদের অবদান মূল্যায়নের জন্য খাতভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তৈরি পোশাক ব্যতীত অন্য খাতের রপ্তানি চিত্র নিম্নরূপ:

৪. রপ্তানিবিরোধী নীতি: দেশীয় উৎপাদনকারী উচ্চ আমদানি শুল্কের মাধ্যমে সরকার আরোপিত সুরক্ষাবাদ ভোগ করে, যা বিদেশি পণ্যের সাথে স্থানীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা হ্রাস করে। স্থানীয় বাজারের সুবিধা ও বৃহৎ আকৃতির স্থানীয় বাজার এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড/কমপ্লায়েন্স প্রতিপালনের আবশ্যকতা না থাকার কারণে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা প্রায়শই রপ্তানি করতে নিরুৎসাহিত হন। রাজস্ব সংগ্রহের জন্য আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরশীলতা রপ্তানি বহুমুখীকরণে বাধা সৃষ্টি করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলছে তাই প্রবৃদ্ধি বজায় এবং রপ্তানি বাজার/গন্তব্য সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে সমন্বিতভাবে কৌশলগত পরিকল্পনার ( Strategic Planning) বিকল্প নেই। এ ব্যতীত  বাংলাদেশকে রপ্তানি সম্ভাবনাময় দেশ এবং অর্থনৈতিক ব্লকের সাথে অর্থনৈতিক অংশীদার চুক্তি (ইপিএ) বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের বিষয়টি বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উদারীকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৫. প্রযুক্তিগত দুর্বলতা: সীমিত প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং প্রযুক্তির দুর্বল ব্যবহার উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে। শ্রম-নিবিড় উৎপাদনের ওপর বাংলাদেশের অতিমাত্রায় নির্ভরতা দেশের প্রযুক্তিনির্ভর খাত বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স বা হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রি, সেমি-কনডাক্টর শিল্পের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতাকে সীমিত করে রেখেছে। উচ্চপ্রযুক্তি শিল্প খাত রপ্তানি বহুমুখীকরণের আওতায় আনয়নের জন্য আমাদের অবশ্যই আইসিটি, দক্ষতার উন্নয়ন, স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত) শিক্ষা, উদ্ভাবন কেন্দ্র এবং মেধা সম্পত্তি সুরক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি।

৬. অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাণিজ্য নীতি: দেশের বাণিজ্য নীতিগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দুর্বোধ্য হওয়ায় ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগে একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সংস্কার বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং তৈরি পোশাক ব্যতীত অন্য খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিসহায়তার অভাব বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু সময় দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তৈরি পোশাক ব্যতীত অন্য খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে বিনিয়োগ প্রসারের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ, বিডা (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ), ম্যান মেড ফাইবার (এমএমএফ) তৈরি অ্যাপারেল,চামড়া,পাট, প্লাস্টিক,কৃষি পণ্য,সেমিকন্ডাক্টর সেক্টর, ইত্যাদি গুরুত্ব দিচ্ছে।

৭. পরিবেশগত এবং কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত সমস্যা: টেকসই উৎপাদন এবং বৈশ্বিক পরিবেশগত মানদণ্ডের সাথে কমপ্লায়েন্স ইস্যু প্রতিপালন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, বিশেষ করে টেক্সটাইল, চামড়া এবং কৃষিপণ্যের মতো খাতগুলোতে এ ধরনের কমপ্লায়েন্স ইস্যু প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বেশি।

এসব নির্ধারিত মানদণ্ড প্রতিপালন না করা গেলে তা বাংলাদেশের জন্য পরিবেশবান্ধব বাজারগুলোতে প্রবেশ অথবা কঠোর বিধিবিধান পালনকারী দেশগুলোতে রপ্তানি বাণিজ্য কঠিন হয়ে যাবে। চামড়া খাতের অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ খাতের প্রসার এবং রপ্তানি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। সাভারে অবস্থিত লেদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (CEPT) কার্যকরভাবে কার্যক্ষম না থাকায় পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চামড়া শিল্প LWG (Leather Working Group) Certification সম্ভাবনাময় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য অপরিহার্য, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পরিবেশগত সমস্যার কারণে  LWG সনদ প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে।

এছাড়া চামড়া প্রায়ই অদক্ষ বা অর্ধদক্ষ শ্রমিক দ্বারা সংগৃহীত হওয়ায় সোর্সিং পয়েন্ট থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করাও আরেকটি চ্যালেঞ্জ। প্লাস্টিক খাতে বৃত্তাকার অর্থনীতি অনুসরণপূর্বক বিশ্বব্যাপী প্রযোজ্য মানদণ্ড প্রতিপালনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য উৎপাদন কৌশল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ খাতের বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। একইভাবে কমপ্লায়েন্স চ্যালেঞ্জের কারণে কৃষি ও বস্ত্র খাতও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো সমন্বিতভাবে সমাধানের জন্য আমাদের অবশ্যই সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে।

৮. দক্ষতার ঘাটতি: রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য বিভিন্ন শিল্পে বিশেষ প্রশিক্ষিত ও দক্ষতাসম্পন্ন জনবল প্রয়োজন। চামড়া, পাট, হস্তশিল্প, গৃহসজ্জা, প্রসাধনী, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আইসিটি খাতে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত জনবলের স্বল্পতার দরুন আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছি এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত পণ্য বহুমুখীকরণ প্রচেষ্টাও ব্যাহত হচ্ছে। জনবল/কর্মশক্তিকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করার জন্য প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমি একটি বাস্তব উদাহরণ আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। মাস কয়েক আগে আমি ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৪০-৫০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জে একটি বিউটি অ্যান্ড হোম কেয়ার ব্র্যান্ড, Remark HB Limited, পরিদর্শন করেছি। বিশ্ববাজারে এ খাতের অপার সম্ভাবনা রয়েছে এবং আমি প্রতিষ্ঠানের চমৎকার কর্মপরিবেশ এবং কমপ্লায়েন্স মানদণ্ড দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এই শিল্পের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার সময় তারা পর্যাপ্ত দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবের কথা তুলে ধরেন। এ শিল্পের জন্য বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন জনবল না থাকায় থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইন হতে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিউটি প্রোডাক্ট সেকশন এর উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বা কারিগরি প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রসাধন সম্পর্কিত বিভাগের অনুপস্থিতির কারণে এই শিল্পের জন্য স্থানীয় প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর সংকট রয়েছে। একইভাবে অন্যান্য শিল্প যেমন লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, হাই-টেক এবং সেমিকন্ডাক্টর খাতেরও দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত স্থানীয় জনশক্তি খুঁজে পেতে লড়াই করছে। জাতীয় স্তরে এই সমস্যাসমূহের সমাধান এবং এ চ্যালেঞ্জসমূহ উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী নীতিমালা এবং এর যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন। 

৯. সীমিত উদ্ভাবন, গবেষণা ও উন্নয়ন: স্থানীয় উৎপাদক-কাম-রপ্তানিকারকদের গবেষণা ও উন্নয়নে আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে, যা অপ্রচলিত রপ্তানি খাতে পণ্য এবং সেবা উদ্ভাবনের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করার অনাগ্রহ এবং বেসরকারি খাত, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সহযোগিতার অভাব রয়েছে, যা বাড়ানো দরকার। গবেষণা ও উন্নয়ন পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র শিল্প ও স্টার্ট-আপদের জন্য ইনোভেশন হাব (Innovation Hub) নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গবেষণা ও উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা সময়ের দাবি। বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মেধাসম্পদ সুরক্ষাকে যুগোপযোগীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ বাজার প্রবেশাধিকার সহজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেমিনার, টকশো, ওয়ার্কশপ এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উদ্ভাবনের জন্য আরও সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে চীন, ভারত এবং ভিয়েতনামেন ন্যায় রপ্তানি বহুমুখীকরণ কৌশল বাস্তবায়ন করে একক পণ্যের নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে ।

১০. লজিস্টিক্স ‍সাপোর্ট: তিন ধরনের বন্দর যেমন আকাশ, সমুদ্র এবং স্থল- এ পর্যাপ্ত লজিস্টিক্স সুবিধা না থাকায় অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি। বাংলাদেশের বন্দরগুলোতে  অদক্ষ কার্গো হ্যান্ডলিং, অপর্যাপ্ত বিস্ফোরক শনাক্তকরণ স্ক্যানার (ইডিএস) মেশিন, অনিয়ন্ত্রিত স্পট এয়ার ফ্রেইট মূল্য, অপর্যাপ্ত গুদাম, কার্গো সুবিধা এবং দক্ষ ও আধা-দক্ষ জনবলের অভাব ইত্যাদির কারণে রপ্তানিকারকদের কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করতে পারছে না। ফলে কৃষিজাত পণ্য, তাজা এবং হিমায়িত মাছ, ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যসহ অন্য পচনশীল পণ্যের রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে  রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণ করার সুযোগ সম্পূর্ণরূপে সদ্ব্যবহার করতে পারছেন না।

১১. বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা: তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স, চামড়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য এবং আইটি পরিষেবার মতো বৈচিত্র্যময় পণ্যখাতের রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের ভিয়েতনাম, ভারত এবং কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ভালো ব্র্যান্ডের অপ্রতুলতা, কমপ্লায়েন্স ইস্যু (পরিবেশ এবং শ্রম) এবং গুণগতমানসম্পন্ন পণ্যের জন্য নতুন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে একতরফা অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধা হারাবে, যা আমাদের প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়ে দেবে। জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আঙ্কটাড) তথ্যানুযায়ী অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা হারানোর ফলে বাংলাদেশ প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো হ্রাস পাবে।

১২. ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগে (এসএমই) সীমিত অর্থায়ন: কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র শিল্প ও স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন ধরনের অর্থায়নের জন্য ব্যাংক থেকে অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়, যা রপ্তানি বহুমুখীকরণের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। উচ্চ সুদের হার এবং জামানতের অভাব উদ্যোক্তাদের নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছে। অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত SME খাত অগ্রাধিকার এবং যথাযথ নীতিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে রপ্তানি বহুমুখীকরণের কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে জাপানের সাফল্যের শিক্ষা বাংলাদেশ অনুসরণ করতে পারে।

রপ্তানি বহুমুখীকরণ কৌশল বাস্তবায়ন রাতারাতি ঘটানো সম্ভব নয় এবং এটি অর্জনের কোনো সহজ পথও নেই। আমাদের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, খাতভিত্তিক নীতিসহায়তা ব্যবসাবান্ধব শুল্ক পদ্ধতি এবং দক্ষ লজিস্টিক পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: পরিচালক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।

এইচআর/জিকেএস/ফারুক