বেগম রোকেয়া, নারী জাগরণের অগ্রদূত তিনি। প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন হলেও বিয়ের পর তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে আখ্যায়িত হন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন তিনি। নারী শিক্ষা, মুসলিম নারীদের শিক্ষা এবং অন্যান্য অধিকারের জন্য তিনি প্রথম সুর তুলেছিলেন। নারী-পুরুষের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তুলেছিল তিনি।
Advertisement
১৮৮০ সালের আজকের এই দিনে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও রক্ষণশীল মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা আবু আলী হায়দার সাবের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। বড় দুই ভাই-বোনের সহযোগিতায় তিনি গোপনে শিক্ষালাভ ও সাহিত্যচর্চা করেন।
সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও বাড়িতে বড় ভাইয়ের সহায়তায় পড়ালেখার সুযোগ পান। সাহিত্য চর্চা করার যথেষ্ঠ উপযুক্ত পরিবেশও ছোটবেলা থেকেই তিনি পেয়েছিলেন। ফলে তিনিই একসময় সামাজিক পশ্চাৎপদতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, নারী সমাজের বহুমাত্রিক অধিকার আদায় ও নারী শিক্ষার পথ নির্দেশক হতে পেরেছিলেন।
তৎকালীন মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তার বোনদের স্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতেই আরবি ও উর্দু শেখানো হয়। কিন্তু তার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবেরের সহায়তায় গোপনে বাড়িতেই বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ লাভ করেন রোকেয়া।
Advertisement
পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুরের এক খানদানি ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারের কীর্তিমান পুরুষ সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেন রোকেয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মুক্তমনের মানুষ সাখাওয়াৎ হোসেনের পত্নী প্রেম ছিল প্রগাঢ়। বেগম রোকেয়ার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব কিছুই করেছিলেন। বেগম রোকেয়ার শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চায় তার স্বামীর ভূমিকার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়।
আরও পড়ুন বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী, টাইটানিক থেকেও বেঁচে ফিরেছিলেনরোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনে দুই জন পুরুষ যথাক্রমে তার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের এবং তার স্বামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
স্বামীর কাছে তিনি ইংরেজি শিখেছিলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ খাওয়াত হোসেন তার লেখাপড়াতে উৎসাহ দিয়েছেন, আবার একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ জমিয়ে রাখতে সহায়তা করেছেন। তার স্বামীর উৎসাহে ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লেখার মাধ্যমে সাহিত্যজগতে তার অবদান রাখা শুরু করেন।
তার রচিত গ্রন্থ যেমন পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর এবং সুলতানার স্বপ্ন প্রকাশের মাধ্যমে নারী সমাজকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার সমসমায়িক নারীদের মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারা ও মুক্ত মনের মানুষ ছিলেন। তিনি ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ অনুচ্ছেদে লিখেছেন, ‘২৫ বছর পূর্বে লিখিত সুলতানার স্বপ্নে বর্ণিত বায়ুযানে স্বপ্নকে সত্যি করতে পেরেছিলাম’। প্রথম মুসলিম অবরোধ-বন্দিনী নারী হিসেবে প্লেনে করে বেগম রোকেয়া আকাশে পরিভ্রমণ করেছিলেন।
Advertisement
১৯০৯ সালে বেগম রোকেয়ার স্বামীর মৃত্যু হলে ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠান করেন। কিন্তু পরবর্তীতে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণে সেটি বন্ধ করে ১৯১১ সালে কলকাতায় ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ পুনরায় চালু করেন এবং ১৯৩০ সালে এটা মেয়েদের হাইস্কুলে উন্নীত হয়।
১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়ে নারী সমাজকে সচেতন করে তুলেছেন। এই সমিতি বিধবা নারীকে অর্থ সাহায্য প্রদান করতো। দরিদ্র মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হতো, অভাবী মেয়েরা সমিতির অর্থে শিক্ষালাভের সুযোগ পেতেন।
বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসে তিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেছেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থানের কথাও তুলে ধরতে তিনি ছাড় দেননি। তিনি তার সাহিত্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে যে নারীকে পিছিয়ে রাখা ঠিক নয়, শিক্ষা লাভের সুযোগ এবং পছন্দ অনুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়া যে নারীর মুক্তি লাভ সম্ভব নয় সমাজকে তা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।
পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতি জীবনের এই তিন প্রধান অনুষঙ্গে নারীকে আত্মমর্যাদাশীল হতে তিনি নারী সমাজকে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বেগম রোকেয়া জোর দিয়ে বলে গেছেন, ‘যাহা যাহা পুরুষ পারিবে তাহাই নারী পারিবে’। এ কথা যে কতটা বাস্তবসম্মত তা আজ সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন।
সাহিত্যিক হিসেবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে রোকেয়া ছিলেন অবশ্যই এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তার সাহিত্য কর্মে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কুফল, নারী শিক্ষার প্রতি তার নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অনাচার ও অপমানের কথা প্রতিফলিত হয়েছে। বেগম রোকেয়া মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, তার জন্মদিবসেই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
বেগম রোকেয়ার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি এখনো সর্বজন স্মরণীয় হয়ে আছেন। বেগম রোকেয়া ১৩৭তম জন্মদিনে গুগল তার নামে একটি ডুডল তৈরি করে। ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা ২০০৯ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নামকরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের জন্য আবাসিক হল বেগম রোকেয়ার নামে নির্মাণ করে। বাংলাদেশ সরকার বেগম রোকেয়া স্মরণে গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে স্থাপন করা হয় বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। যা বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন জীবনের ১০০ বসন্ত পার, প্রেমের পর ঘর বাঁধলেন দম্পতি পাট-বেতের হাতে তৈরি পণ্যে সফল উদ্যোক্তা মারিয়াকেএসকে/জিকেএস