বিশ্ব রাজনীতিতে পরপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো।
Advertisement
১. সিরিয়া বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাওয়ার পরে পালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন ধরে দেশটির ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এবং ২. সামরিক শাসন জারি করেও বিক্ষোভের মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল।
এই দুটি ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের মিল-অমিলগুলো কী এবং এখানে বাংলাদেশের শাসক ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মেসেজ কী?
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ যেদিন ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, তার চার মাস আগে একইরকম ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। এখানেও অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তিনি গেছেন সামরিক বাহিনীর উড়োজাহাজে।
Advertisement
বাশার আল আসাদের সঙ্গ শেখ হাসিনার একটি বড় মিল হলো এই যে, বাশারের পরিবার যুগের পর যুগ সিরিয়া শাসন করে আসছিল। শেখ হাসিনার পরিবারও তাই। বাংলাদেশ রাজনীতি মূলত দুটি পরিবারকেন্দ্রিক। একটি শেখ পরিবার। আরেকটি জিয়া পরিবার। মাঝখানে এরশাদ পরিবার আরেকটি ডাইনেস্টি তৈরির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুত এরশাদের দল জাতীয় পার্টি এখন একটি ক্ষয়িষ্ণু সংগঠন।
পৃথিবীর দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের পরিণতি মোটামুটি অভিন্ন। তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকেন এবং একপর্যায়ে হয় দেশের ভেতরে অভ্যুত্থানের মুখে তাদের পতন হলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, না হয় তারা দেশের ভেতরেই কারাবন্দি থাকেন অথবা কোনো বিদেশি শক্তি এসে তাদের উৎখাত করে। যেমন সিরিয়ার প্রতিবেশী ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি। দুজনই তাদের দেশে দীর্ঘ সময় শাসন করেছেন এবং ধীরে ধীরে তারা স্বৈরশাসকে পরিণত হন।
এই দুই প্রেসিডেন্টের আমলে তাদের দেশে কী পরিমাণ উন্নতি হয়েছে; মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল—সেটি একটি তর্ক। অন্য তর্ক হলো কোনো শাসক যখন স্বৈরাচার বা একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন তখন তার দেশ থেকে প্রথমেই উধাও হয়ে যায় নির্বাচন। অর্থাৎ ওই শাসকরা মনে করেন, দেশ শাসনের অধিকার কেবল তার বা তার পরিবারের। অতএব নাগরিকের ভোট দেয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু নাগরিক ভোট দিতে চায়। ভোট দিয়ে সে হয়তো ওই স্বৈরশাসককেই ক্ষমতায় আনবে। কিন্তু সে তার নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবতে চায়।
সংবিধান তাকে যে ‘রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক ঘোষণা’ করেছে, সেই মালিকানা প্রয়োগের যেহেতু আর কোনো উপায় নেই, ফলে তার পেটে যতই ভাত থাকুক না কেন, সে ভোট দিয়েই তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চায়। শাসক যত ভালোই হোক না কেন, সে ওই শাসক এবং তার দলের বা তার সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্র যখন তার এই ভোট ও সমালোচনা করার অধিকার কেড়ে নেয়; যখন সরকারের সমালোচনাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’ বা ‘উন্নয়নবিরোধিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে নাগরিক বা দলীয় কর্মীকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়, তখন ভেতরে ভেতরে জনঅসন্তোষ ও ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।
Advertisement
কোনো না কোনো সময়ে গিয়ে ওই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। বিদেশি শক্তিগুলো, বিশেষ করে ওই দেশে যদি কোনো শক্তিশালী দেশের স্বার্থ থাকে, যদি তারা ওই দেশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়—সেটি হোক তার প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ইস্যুতে, তখন ওই বিদেশি শক্তি স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ ও বঞ্চনায় ‘বাতাস’ দেয়। তারা কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে ওই ক্ষোভ উসকে দিয়ে আন্দোলন বেগবান করে এবং একপর্যায়ে ওই স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়।
সাদ্দাম ও গাদ্দাফীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এই দুটি দেশেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট স্বার্থ রয়েছে, ফলে তারা এই দুই শাসকের স্বৈরাচারী মানসিকতার বিরুদ্ধে তাদের দেশের রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়ে তাদের হত্যা করেছে। যদি সাদ্দাম হোসেন ও গাদ্দাফী স্বৈরশাসকে পরিণত না হতেন, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের পক্ষে তাদের উৎখাত করা বা হত্যা করা বেশ কঠিন হতো। কেননা জনগণই তখন রুখে দাঁড়াতো।
আরেকটি বাস্তবতা হলো, যখন কোনো একটি পরিবার কোনো দেশে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের পক্ষে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হতে থাকে। কেননা তাদের মধ্যে এমন এতটি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় যে, তারা যা করবে তাই সঠিক এবং দেশ শাসনের অধিকার কেবল তাদেরই। এভাবে তারা ভেতরে ভেতরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শাসক জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তিনি তার আইনশৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনীর ক্ষমতায় ভর করে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও কোনো না কোনো পর্যায়ে গিয়ে সেটিও আর তাকে রক্ষা করতে পারে না। যেমন পারেনি সিরিয়ায় এবং তার আগে বাংলাদেশে।
সিরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বার্তা হলো, মানুষ আসলে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত শাসক চায়। অনির্বাচিত সরকার যতই জনবান্ধব হোক না কেন, দিন শেষে মানুষ আসলে ভোট দিতে চায়। ভোট দিয়ে সে সংবিধানপ্রদত্ত মালিকানার প্রয়োগ ঘটাতে চায়। সে কথা বলতে চায়। সরকারের যেকোনো কাজের সমালোচনার অধিকার চায়।
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, তারা যখন দামেস্কে ঢুকে পড়লো তখন সরকারি বাহিনী কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। তার মানে সরকারি বাহিনীও আর শেষ পর্যন্ত বাশারকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি অথবা তারা ভেবেছে এখানে প্রতিরোধ গড়ে তুলে লাভ নেই। বাংলাদেশেও জুলাই অভ্যুত্থানে শেষ পর্যন্ত পুলিশ যেভাবে সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেছে, সেনাবাহিনী সেটি করেনি। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাতে সেনাবাহিনী যদি সরকারকে টিকিয়ে রাখা তথা আন্দোলন দমনের জন্য চূড়ান্ত হার্ড লাইনে যেত, তাতে আরও অনেক প্রাণহানি হলেও শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা টিকে যেতেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
দ্বিতীয় ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল সামরিক শাসন জারি করলেও সংসদ ও রাজপথে অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। এরইমধ্যে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীও পদত্যাগ করেছেন। গত শনিবার সকালে জাতির কাছে প্রেসিডেন্ট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং অভিশংসন ভোটের আগে পদত্যাগের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের বয়কটের মুখে তিনি এ যাত্রা বেঁচে গেছেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কেননা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবিতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই ঘটনাটি আমাদের দুটি মেসেজ দেয়।
১. সামরিক শাসন জারির মতো একটি গণবিরোধী কাজ করেও প্রেসিডেন্ট টিকে গেলেন ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের কারণে। বাংলাদেশেও অনেক সময় গণবিরোধী আইন এমনকি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সংবিধানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র এমপিদের চুপ থাকার কারণে। তাদের চুপ করিয়ে রাখার জন্য সংবিধানেই বিধান রয়েছে। ফলে তারা কোনো সিদ্ধান্তকে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী মনে করলেও তার বিরুদ্ধে সংসদে বা সংসদের বাইরে কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেন না। কেননা তারা যে ক্ষমতাকাঠামোর অংশ, সেটিকে শক্তিশালী রাখতে চান।
২. দক্ষিণ কোরিয়ার এই ঘটনাটি দ্বিতীয় যে মেসেজ দিলো তা হচ্ছে, গণতন্ত্রই শেষ কথা। মানুষের পেটে যতই খাবার থাকুক, তার অর্থনৈতিক অবস্থা যতই ভালো থাকুক, সে দিন শেষে ভোট দিতে চায়। ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়। সে কথা বলতে চায়। সে এমনকি সরকার ও সরকারপ্রধানেরও সমালোচনার অধিকার চায়। বিশ্বের যেসব দেশে যুগের পর যুগ সমাজতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন চলছে, সেসব দেশের মানুষের মনেও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এমনকি উত্তর কোরিয়ার মানুষও হয়তো চায় তার দেশে নির্বাচিত সরকার আসুক, যে সরকারটি আসবে তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে। সেই দেশের মানুষও চায় সে মন খুলে লিখবে ও বলবে এবং এই বলা ও লেখার কারণে তাকে জেলে যেতে হবে না বা তার জীবন হুমকিতে পড়বে না।
সিরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বার্তা হলো, মানুষ আসলে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত শাসক চায়। অনির্বাচিত সরকার যতই জনবান্ধব হোক না কেন, দিন শেষে মানুষ আসলে ভোট দিতে চায়। ভোট দিয়ে সে সংবিধানপ্রদত্ত মালিকানার প্রয়োগ ঘটাতে চায়। সে কথা বলতে চায়। সরকারের যেকোনো কাজের সমালোচনার অধিকার চায়।
সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার জরুরি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেবে, ততই মঙ্গল। আর যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসবেন তাদের জন্য মেসেজ হলো, তারা যদি আগের মতোই দেশের মানুষ ও সংসদকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনী, তার প্রশাসন ও দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে দেশ চালানোর চিন্তা করেন; তারাও যদি স্বৈরশাসকে পরিণত হন—তাহলে তাদের পরিণতিও হবে বাশার আল আসাদ কিংবা শেখ হাসিনার মতো।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/জেআইএম