রাজশাহীসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলেই সার ও বীজ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই আলু চাষিদের। আলু চাষের ভরা মৌসুমে হঠাৎ সারের দাম বৃদ্ধিতে ও ভালো বীজের সংকট নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃত্রিম এই সংকটের জন্য অসাধু ব্যবসায়ী ও কিছু কৃষি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন কৃষকেরা। কোথাও চাহিদামতো সার না পেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে বস্তা প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়েও সার কিনছেন অনেকেই।
Advertisement
তবে কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কৃষকদের সাথে গ্রুপ মিটিং এবং ইয়ার্ড মিটিং করছেন তারা। পাশাপাশি পরবর্তীতে অনুমোদিত মাত্রার বেশি সার প্রয়োগ রোধে অব্যাহত আছে প্রচারণার কাজও। কৃষকেরা অবশ্য বলছেন, তাদের জমিতে সার ও কীটনাশকের যথাযথ প্রয়োগ সম্পর্কে তাদের সচেতন করার জন্য সরকারের উদ্যোগগুলো খুব অপর্যাপ্ত। কারণ তাদের বেশিরভাগই এ সম্পর্কে অবহিত হননি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ১০৬ লাখ টন আলুর মধ্যে শুধু রাজশাহীতেই উৎপাদিত হয়েছে ৭৯ লাখ টন। তবে রেকর্ড উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প কর্পোরেশন চলতি মৌসুমে বীজ ও সার বরাদ্দ বৃদ্ধি করেনি। ফলে আলু বীজ ও সারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত বীজ ও সারের দাম বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছিল। তবে এ বছর আলু চাষের হিড়িক পড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূল থাকলে ৩৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি থেকে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় আলু ফলনের এ লক্ষ্যমাত্রা সর্বোচ্চ। তবে কৃষকদের অভিযোগ, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের ডিলাররা বরাদ্দ কম থাকায় তাদের কাছ থেকে প্রতি বস্তা সারের ৪৫০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত নিচ্ছে।
Advertisement
তানোর উপজেলার কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কৃষিজমিতে কখন এবং কতটা সার প্রয়োগ করতে হবে, তা আমরা আসলে জানি না। বর্তমানে আমরা পূর্বপুরুষদের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করি। দুটি বস্তা (১০০ কেজি) এমওপি (মিউরেট অব পটাশ), এক বস্তা (৫০ কেজি) ড্যাপ (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) এবং এক বস্তা টিএসপি (ট্রিপল সুপারফসফেট) প্রতি বিঘা জমিতে আলু বীজ রোপণের আগে ব্যবহার করি। আলুর পাতা গজালে আমরা আবার অল্প পরিমাণ সার দেই।’
তিনি বলেন, ‘আমার ১৫ বিঘা জমিতে আলু চাষের জন্য ৩০ বস্তা এমওপি, ১৫ বস্তা ড্যাপ এবং ১৫ বস্তা টিএসপি প্রয়োজন। বিসিআইসি ডিলারের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও সরকার নির্ধারিত দামে মাত্র এক বস্তা এমওপি সার পেয়েছি।’
একই উপজেলার আরেক কৃষক মোস্তাকিন ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বিঘা জমিতে আলু বীজ লাগানোর আগে দুই বস্তা এমওপি, দেড় বস্তা ড্যাপ এবং আধা বস্তা টিএসপি প্রয়োগ করছি। আমরা যত বেশি সার ব্যবহার করবো, মৌসুম শেষে তত বেশি ফলন পাবো।’ আলু চাষের জন্য তাদের জমিতে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগের কেউ যোগাযোগ করেছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি নেতিবাচক জবাব দেন।
আরও পড়ুনশসার বাম্পার ফলন ও ভালো দামে খুশি চাষিরাজামালপুরে ফুলকপি ও লাউয়ের মিশ্র চাষে লাভবান আনিসবাগমারা উপজেলার কৃষক খোরশেদ আলম জানান, তারাও প্রতি বিঘা জমিতে দুই বস্তা এমওপি এবং এক বস্তা টিএসপি ও ড্যাপ প্রয়োগ করছেন। বেশি ফলন পাওয়ার লক্ষ্যে তারা আলু ক্ষেতে সার প্রয়োগে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
Advertisement
এদিকে পবা উপজেলার বায়া বাজারের একটি বিসিআইসি ডিলারের দোকানে সরেজমিনে দেখা যায়, সরকার নির্ধারিত দাম এক হাজার টাকার এমওপি ১ হাজার ১৮০ টাকায়, ১ হাজার ৫০ টাকার ড্যাপ এক হাজার ৩০০ টাকা ও ১ হাজার ৫০ টাকার টিএসপি ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দোকানের এক কর্মচারী বলেন, ‘কৃষকদের চাহিদার বিপরীতে বিসিআইসি বরাদ্দ খুবই কম হওয়ায় অন্য জায়গা থেকে সার সংগ্রহ করেছি। যখন একজন কৃষকেরই ২০০ বস্তার প্রয়োজন হয়, তখন প্রতিটি ডিলারের জন্য মোট ১২০ বস্তা টিএসপি বরাদ্দ করা হয়েছিল।’
তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক কাওসার আলী বলেন, ‘প্রতি বিঘা জমি আলু চাষের উপযোগী করতে ২০ থেকে ২৫ কেজি এমওপি এবং টিএসপি বা ড্যাপই যথেষ্ট। সচেতনতার অভাবে কৃষকেরা অতিরিক্ত সার ব্যবহার করছেন; যা সারের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারের কারণে কৃষকদের শুধু আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে না, ফসলি জমির ওপরের মাটিও নষ্ট হচ্ছে, ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে সালমা বলেন, ‘আমরা কৃষকদের সচেতন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি যাতে তারা তাদের ফসলি জমিতে অনুমোদিত মাত্রার সার প্রয়োগ করতে পারেন। আমরা প্রতিনিয়ত কৃষকদের সঙ্গে গ্রুপ মিটিং ও ইয়ার্ড মিটিং করছি। জমিতে যাতে অনুমোদিত মাত্রার বেশি সার প্রয়োগ করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
কোনো ডিলার যেন কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতে না পারে। এ ব্যাপারে কেউ কোনো অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণেরও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
সাখাওয়াত হোসেন/এসইউ/জেআইএম