মতামত

আরো বড় পুরস্কার চাই আমাদের

 

আমরা যে ইনোভেটিভ জাতি তার জন্য খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। আমাদের লোক কারিগরিগুলোর বিচার করলেই আমরা জানতে ও বুঝতে পারবো, প্রায়োজনে কী কী অর্জন করেছি। এই চাষের লাঙল, নিরানির জন্য পাজন, গরু খেদানোর জন্য নড়ি, সংসার সাজনোর প্যাটার্ন, রান্নার বিধি-ব্যবস্থা ইত্যাদি তো আমাদেরই চিন্তার ফসল। জাতি হিসেবে আমরা যে ক্রিয়েটিভিটিতে প্রাগ্রসর, সেটা তো ব্রিটিশ আমলেই বলা হয়েছে। বাংলা যা আজকে ভাবে, বাকি ভারত তা কালকে চিন্তা করে। কিন্তু তারপরও আমরা কি মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়িনি?

Advertisement

ঢাকার মানুষ, মানিকগঞ্জের বসতি অমর্ত্য সেন তো নোবেল পেয়েছেন ভারতের হয়ে! আমাদের নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস, বর্তমান পৃথিবীতে কতোটা প্রভাবশালী মানুষ, তা কি বিশ্ববাসী কম জানে? সত্যের বোসের কথা নাই বা তুললাম। আমাদের সমাজে এমন আরো অনেকেই আছেন যারা নোবেল পাওয়ার মতো ইনোভেটিভ কাজ করে চলেছেন। কিছু দিন আগে ফেসবুকে পড়েছি, একজন কৃষি বিজ্ঞানী এমন ধানচারা উদ্ভাবন করেছেন, যা বছরে চারবার এক গাছ থেকেই ফসল দেবে। একটি ধানগাছ একবার নয়, চারবার ধান দেবে। এই উদ্ভাবন আমাদের নোবেল পুরস্কারের লোভ দেখায়। কিন্তু নোবেল যারা দেন তারা ভেতোবাঙাল নন, তাদের খাদ্যকণা আসে গম, যব ইত্যাদি থেকে। তাই ভাতের ক্ষুধা তারা বুঝবেন না। কিংবা আবার বুঝতেও পারেন।

আমি অতি সম্প্রতি দুটি পুরস্কারের কথা বলবো। একটি হচ্ছে আইসিডিডিআরবি’র একজন মহিলা বিজ্ঞানী পেয়েছেন ভিনফিউচার পুরস্কার। আর একজন, তিনিও আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী/কর্মকর্তা পেয়েছেন গেটস ফাউন্ডেশনের পুরস্কার গোলকিপার্স চ্যম্পিয়ন পুরস্কার। তিনি ড. তাহমিদ আহমেদ।

গেটস ফাউন্ডেশনের বিশেষ স্বীকৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. আহমেদ বলেন, গোলকিপারস চ্যাম্পিয়ন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া একটি বড় সম্মানের বিষয়। এই পুরস্কার আইসিডিডিআরবিতে আমার সহকর্মী ও বিশ্বজুড়ে অনেক সহযোগী গবেষকসহ অনেকের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল। অপুষ্টি এখনো রয়ে গেছে। এটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতার কারণে প্রতিটি শিশু যেন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে, তা নিশ্চিত করার লড়াই অনেক বেশি জরুরি। আর এটি নিশ্চিত করতে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর, আরও সহনশীল বিশ্ব গড়ে তুলতে আমাদের গবেষণা এবং উদ্ভাবনী সমাধানে বিনিয়োগ চালিয়ে যেতে হবে।

Advertisement

অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রকাশিত ২০২৪ গোলকিপারস প্রতিবেদন, দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে, উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. আহমেদের উদ্ভাবনী সমাধানের মতো আরও সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা এই সংকট মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য।

প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত চার কোটি শিশুকে স্টান্টেড বা খর্বকায় হওয়া ও ২৮ মিলিয়নের বেশি শিশু কৃশকায় হওয়া রোধ করার জন্য বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

এই রিপোর্টটুকুই আমাদের বলছে যে কোন ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে আমরা বাস করছি। গোটা মানবজাতির জন্যই তো এই সংকট, যা মানুষকে তার স্বাভাবিকতা থেকে অস্বাভাবিকতায় নিয়ে যাবে। শিশুপুষ্টি নিয়ে অবদানের জন্য তাহমিদ আহমেদকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। শিশুপুষ্টি, বিশেষ করে মাইক্রোবায়োম-ডিরেক্টেড রেডি টু ইউজ বা সহজে ব্যবহারোপযোগী থেরাপিউটিক ফুড নিয়ে তাঁর কাজ রয়েছে। তাঁর কাজ বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অপুষ্টি মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

প্রায় ১৯ কোটি জনসংখ্যার কতোভাগ শিশু আর তার কতোভাগ অপুষ্টির শিকার, তা কি আমরা জানি? জানি, কিন্তু তা বলবো না স্বীকারও করবো না। স্বীকার করলে তো আমরা যে উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছি, দেশকে সিঙ্গাপুর ও কানাডায় পরিণত করে এখন পলাতকা হয়ে দিল্লিতে বাস করছেন- তিনি এবং ধুয়া ধরা বেহারাদের মান-ইজ্জত থাকে না। এই প্রতিষ্ঠানটি, আইসিডিডিআর বিই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনেছে তার উদারাময়ের সহজ ও সাধারণ স্যালাইন আবিষ্কার করে। পৃথিবীর মানুষ সেই থেকে বাংলাদেশকে চেনে। তারপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পাওয়ায়, গোটা বিশ্ব চেনে বাংলাদেশকে। বলে ওহ, তুমি ইউনূসের দেশের মানুষ।

Advertisement

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী ভিনফিউচার স্পেশাল প্রাইজ পেয়েছেন। কলেরা, টাইফয়েড এবং হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের (এইচপিভি) সুলভ মূল্যের টিকা উদ্ভাবনে অবদান রাখার জন্য তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের উদ্ভাবক ক্যাটাগরিতে তিনি এ পুরস্কার পেয়েছেন।

ফেরদৌসী কাদরীও আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী। কলেরা, টাইফয়েড এবং হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি)টিকা উদ্ভাবনের জন্য ডে পুস্কারটি তিনি পেয়েছেন, তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ভিয়েতনামের হ্যানয়ের ভিনফিউচার পুরস্কার ফেরদৌসীর জন্য যতোটা না সম্মানের হয়েছে, তার চেয়েও এই স্বীকৃত ভিকটিম গরিব মানুষের জন্য সব থেকে উপকারে আসবে— যা সত্যই ভালো অবদান।

ভিনফিউচার পুরস্কার দুটি ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়। একটি গ্র্যান্ড প্রাইজ, আরেকটি স্পেশাল প্রাইজ। ২০২৪ সালে বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশ ও ভূখণ্ডের প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তিকে এ দুই ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন দেওয়া হয়। চলতি বছর ভিনফিউচার পুরস্কারের বিষয়বস্তু ছিল ‘রিজিলিয়েন্ট রিবাউন্ড’ বা অদম্য ঘুরে দাঁড়ায়। ফেরদৌসী কাদরীর কাজে এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

পুরস্কার গ্রহণের সময় দেওয়া বক্তৃতায় ফেরদৌসী কাদরী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, উন্নয়নশীল দেশের উদ্ভাবন বিভাগে ভিনফিউচার পুরস্কার পাওয়ায় আমি গভীরভাবে সম্মানিত বোধ করছি। চার দশক ধরে আমি সংক্রামক রোগ, বিশেষ করে কলেরা, টাইফয়েড এবং এইচপিভির টিকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য সুলভ মূল্যে উদ্ভাবনের কাজে মনোনিবেশ করেছি। শিশু ও নারীদের জন্য এটা বিশেষভাবে কাজে লেগেছে। এই যে উদ্ভাবনা, এর স্বীকৃতিই আমাদের পাথেয়। আমরা বলতে পারবো এতাগুলো অর্জনের মালিক আমরা।

লেখক: কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস