ও কী গাড়িয়াল ভাই, গানের ভাষা যে আমার অজানাকীর্তন জাগে না আর গভীর চিত্তে, আর কত যে অপেক্ষা
Advertisement
এরকম বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে নাকি মুক্তোর মালা গাঁথা যায়। কদমফুলের দানার মতো অসংখ্য অবিরল মুক্তো ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। সুশীলার বাড়িতে এসে পার্থ অদ্ভুতভাবে আটকা পড়ে গেল এই বৃষ্টির কারণে। অবশ্য বৃষ্টির মধ্য দিয়েও চলে যাওয়া যায়। তবে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বেশ ঠান্ডা, বাতাস শান্তহিম। আকাশেও একটা ঝড়ো ঝড়ো ভাব বিরাজ করছে। প্রকৃতি যেন বর্ষার চেহারা ধারণ করেছে। এসব লক্ষ্য করেই সুশীলা জোর করে পার্থকে আটকে রেখেছে। হঠাৎ সুশীলা বলে উঠল: দেখে মনে হচ্ছে, তুমি শরীরের ওপর খুবই অযত্ন করছো। এই বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার শরীর আরও খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং আধৃত গোধূলির এই কদম্ববৃষ্টির বরিষণ না-হয় দুইজনে মিলে শেষবারের মতো দেখে নিই।
তারা উভয়ই অনুভব করছে, তাদের মধ্যে একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছে। ব্যবধান শুধু নয়, শীতল এক সম্পর্ক। কোনো সন্দেহ নেই, পাশাপাশি দাঁড়িয়েও যেন এক অদ্ভুত নিঃসাড় পৃথক হয়ে রয়েছে। শ্যাওলা নোনা-ধরা দেওয়াল থেকে যেমন অণুবিন্দু স্যাঁতসেঁতে জলকণা চুইয়ে পড়ে, বালি ঝরে যায়, তেমনই অবহেলা-উপেক্ষায় পীড়িত অভিমান, গ্লানি ঝরে পড়ছে সুশীলার অন্তর্দেওয়াল থেকে। পার্থ এতই নিরুত্তাপ, এতই নির্লিপ্ত যে, তার অন্তরের রাগ কিংবা ক্ষোভ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না বরং বিস্ময়ে পার্থের চোখ দুটি বড় হয়ে ফুটে উঠল। বলল: প্রকৃতি অনেক সময় নিজের নিয়মও মানে না। আর মানুষের বেলায় তো কোনো কথা নেই। তাই হয়তো আমি অবশেষে হার মানলাম, সুশীলা।
বৃষ্টি এবার ঘন হয়ে ঝরতে শুরু করল। আঁধার হয়ে আসছে দিগন্ত। বিদ্যুৎ চমক হলো, আবার মিলিয়েও গেল। সুশীলা দিগন্তপানে তাকালে শুধু অতীত চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। মন ছুটে যায় অতীতে, আরও অতীতে। দুই হাত প্রসারিত করে চঞ্চল তরুণের মতো সুশীলাকে জড়িয়ে ধরল পার্থ। ব্যথা জড়ানো কণ্ঠে বলল: যা শুদ্ধ নয়, তা ভালোবাসা কিংবা প্রেম হতে পারে না। তা ক্ষণিকের মোহ কেবল। এজন্যই আমি তোমাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারি না।
Advertisement
পার্থকে স্থির দৃষ্টিতে দেখতে থাকে সুশীলা। মুখের আকৃতি কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন প্রেম ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পার্থের দুই হাত তার দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বলল, আত্মা শুদ্ধ হলেই সৃজিত হয় প্রেম। সুশীলার সুমিষ্ট বাক্যে পার্থের মন ভরে না। চন্দ্রার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেকে সে ভাবছিল, বুঝি একবার সুশীলার মুখখানি দেখলেই তার হৃদয় জুড়োবে। সুশীলার কাছে এসে দাঁড়াতেই বুঝল, পতঙ্গ যেমন অগ্নিশিখার দিকে ধায়, তেমনই সুশীলার রূপরাশির মধ্যে সে চায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকতে, তবে সুশীলা কিছুতেই তাকে প্রশ্রয় দিলো না, দেবেও না; বরং বলল: তুমি কি চাও আমি আরও কষ্ট পাই? তার চেয়ে মরণই তো ভালো, তাই না!আর তো কিছুই চাইনি, শুধু... বড্ড পুরাতন চাহিদা।এমন কথা ভাবাও পাপ। আমি শুদ্ধ থাকতে চাই। তুমিও অবশ্যই চাও আমি শুদ্ধ থাকি? প্রেম কখনো অশুচি হয় না, সুশীলা। বৃষ্টি এবার সাঁই সাঁই করে বইতে শুরু করেছে। আরও ঘন হচ্ছে। পার্থ বলে চলল: কাউকে আমি ভালোবাসি না, তোমাকে ছাড়া। এত গুটিয়ে পড়া কি ভালো!তুমি এখনো অন্যের কাছে বন্ধক।পার্থ উন্মত্তবৎ হয়ে উঠল। সে জেদ ধরল, সুশীলার এই অপবাদ সে ঘোচাবেই। সুশীলাকে না পেলে তার জীবন পুরোটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। সে ছাড়া এই জগতে এই মুহূর্তে আর-কিছু দেখতে পাচ্ছে না পার্থ। সুশীলার মুখের ওপর থেকে দুটি হাত সরিয়ে নিয়ে পার্থ বলল, আমি আর কারো নই। আমি শুধুই তোমার। আমাকে বিশ্বাস করো, সুশীলা। আমাকে বিশ্বাস না করলে তুমিই কষ্ট পাবে। তাই অনুরোধ, আমাকে পূর্ণ করো, সম্পূর্ণ করো তুমি।বিশেষ আশ্চর্য স্বরে সুশীলা বলে উঠল: এভাবে বোলো না, দোহাই তোমার। তোমার মুখ থেকে এমন কথা শোনার চেয়ে আমার মরণই ভালো। আমাকে ভুলে যাও।সুশীলার দুটি হাত পার্থ অব্যক্ত আশ্বাসে ও হৃদয়াবেগে নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলো। এই স্পর্শের মধ্যে গভীর বিশ্বাস জড়ানো। শ্রাবণেরই হৃদি অনুভব যেন। অন্ধকার নেমে এসেছে। মাঝেমধ্যে বিজলি চমকাচ্ছে। দুইজন দুইজনকে দেখতে থাকে খুব কাছ থেকে, একে অপরের চোখের তারা পর্যন্ত।
রমেশ চক্রবর্তীর মুখের গম্ভীর ভাব দেখে বিমলা উদ্বিগ্ন হলেন। দৃষ্টি অবনত কনের মতো, মৃদুস্বরে বললেন: এই বর্ষণসন্ধ্যায় এত ঘেমে আসার দরকার কী ছিল? সুকান্ত কথা শোনেনি সেটা তো তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। আমি তো বারণই করেছিলাম। গরিবের কথা বাসি হলেও অমৃত সুধা।ক্রোধে অপমানে রমেশ চক্রবর্তীর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুখ গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন। উচ্চ স্বরে বললেন, থামো। রমেশ চক্রবর্তীও কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়। সে যে-ই হোক। দেখে নেব ওর কেমন স্পর্ধা। বিমলার অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত কেঁপে উঠল। ছিঃ, রমেশ চক্রবর্তী এটা কী বলছেন! তার বিষাক্ত ছায়ায় সুকান্তের জীবনকে দূষিত করার অধিকার কে দিয়েছে? বিমলার দুর্বল হৃদয় তার স্বামীর প্রবল আঘাতে যতই অবসন্ন হয়ে পড়ুক-না কেন, তারপরও যথাসাধ্য শান্ত স্বরে বললেন: সুকান্ত তো তোমারই প্রিয় পাত্র ছিল, সমজাতের।রমেশ চক্রবর্তী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ওই নাম আর আমার সামনে উচ্চারণ করবে না। ‘সু’ নয়, ‘কু’, অর্থাৎ ও কুকান্ত।কিছুক্ষণ নীরব থেকে ঈষৎ কম্পিত কণ্ঠে বিমলা বললেন, তাহলে গালিটা তোমারই প্রাপ্য; কারণ, তুমিও কুলীন, সে-ও কুলীন।রমেশ চক্রবর্তী অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়লেন। তিনি অপলক দৃষ্টিতে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অবশেষে বললেন: তুমি যে এত নিষ্ঠুর হবে, তা আমি ভাবতেই পারি না। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। আমি কারো কথা ভাবতে চাই না। একথা শেষ হতে-না-হতেই তিনি একটা পরিচ্ছন্ন খাটে চুপচাপ সমাধিশয়ানে শুয়ে পড়লেন, তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বললেন: জল।বিমলার বুকটি মোচড় দিয়ে উঠল। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। এক ঘটি জল নিয়ে ফিরেও এলেন, বললেন: এই নাও।জলপানেও যেন রমেশ চক্রবর্তীর কষ্ট হচ্ছে।
নির্জন বারান্দার একটি ক্ষীণ প্রদীপের সামনে এসে দাঁড়াল কার্তিক। তার চোখে যে-দৃশ্য ধরা দিলো তাতে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সংকুচিতভাবে কিছুক্ষণ নীরব রইল। তার পদশব্দও রমেশ চক্রবর্তী কিংবা বিমলার কর্ণগোচর হলো না। বিমলার পরিধানে লাল পাড়ের সাদা গরদের শাড়ি, সুগৌরকান্তি তার মধ্যে থেকে যেন জ্যোতি বিকীর্ণ করছে। রুক্ষ কেশ পিঠে অসংবদ্ধভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কার্তিকের মনে হলো: যেন কোনো এক শুচিস্নাতা তপস্বিনী ঠাকুরের সম্মুখে ধ্যানে রত। বলল, মেসো ঘুমোচ্ছেন নাকি? রমেশ চক্রবর্তী নিশ্চুপ। বিস্ময় দৃষ্টিতে একবার কার্তিককে দেখে নিলেন। কার্তিক আবার বলল, আপনার শরীর খারাপ নাকি মেসো? বিমলাও নিরুত্তর। অতঃপর কার্তিককে একবার নিরীক্ষা করে বিস্ময়সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে বললেন: কী আর হবে, কার্তিক? শুনেছ তো চন্দ্রা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে করতে চায়।কার্তিক একটু এগিয়ে এলো। একটা জলচৌকি টেনে বসতে বসতে বলল, চন্দ্রা বিয়ে করবে সে তো শুভসংবাদ। সবকিছু আপনাদের ইচ্ছেমতো করবে তার তো কোনো মানে নেই। চন্দ্রা কাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে?হেঁকে উঠলেন বিমলা, তুমি আর বাপু তোমার মেসোকে জ্বালাতন কোরো না। একেই মানুষটি তেতেপুড়ে এসেছেন। এখন তোমার কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেনই।বিমলার কথায় কার্তিক অসম্ভব চমকে গেল, তারপর ফিকে হেসে বলল: তা জ্বলুন। আমি ভবঘুরে মানুষ, কখন কোথায় থাকি তার ঠিকঠিকানা নেই। আমার ওপর রাগ করেও কোনো লাভ নেই, যদিও রাগ করার পুরো অধিকার আপনাদের রয়েছে। মাসি, চন্দ্রাকে তো আমিও কোলে-পিঠে বড় করেছি। আমার মুখে-মুখে সে ছড়া বাঁধতে শিখেছিল। গান বাঁধতে শিখেছিল। আমাকে দাদা বলেই সে জানে। এই অধিকারেই বলছি, মেসোর কাছ থেকে সবই শুনতে চাই।রমেশ চক্রবর্তী রুক্ষ স্বরে বললেন, কী শুনতে চাও?রমেশ চক্রবর্তীর ওপর দৃষ্টিস্থাপন করে কার্তিক বলল: মেসো, কার ওপর রাগ করেছেন? চন্দ্রা আপনার একমাত্র কন্যা। তার ওপর রাগ করলে কি চলে?রমেশ চক্রবর্তীর চক্ষু জ্বলে উঠল। ক্ষোভে, বিস্ময়ে বিমূঢ়ের মতো কার্তিকের দিকে তীব্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন: তা তুমি কী বলতে চাইছো? যে মেয়েকে আমি এত বড় করলাম, তার অবাধ্যতা মেনে নেব? মা-বাবার মতে বিয়ে হলে তা অন্য কথা ছিল। তাই বলে একেবারে অক্ষেত্রে! সমাজে মুখ দেখাব কীভাবে?কার্তিক অভিমানস্ফুরিত অধরে, দীপ্তচক্ষে ও আবেগকম্পিত স্বরে বলল: কী-যে বলেন না মেসো! এসব আজকাল কেউ ভাবে না। তা চন্দ্রা কাকে বিয়ে করতে চাইছে তা তো বললেন না?
রমেশ চক্রবর্তীর মনের জ্বালা দ্বিগুণ জ্বলে উঠল। বাড়িতে আগুন লাগলে রুদ্ধদ্বারগৃহের মধ্যে থাকা মানুষেরা যেমন কোনো উপায় স্থির করতে না পেরে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে, ঠিক সেই অবস্থাই হলো রমেশ চক্রবর্তীর। বললেন: কে আবার? ওই যে... সুকান্ত। ওর ওপর আমার কন্যার অসীম আকর্ষণ। কার্তিক পলকহীন নেত্রে তাকিয়ে বলল, আমাদের সুকান্ত! অতি উত্তম। সে ভীষণ ভালো ছেলে। সে আপনাদেরই প্রিয়পাত্র ছিল। কলেজ থেকে সদলবলে অনেক এসেছে এই বাড়িতে। আমার সঙ্গে কত গল্প করেছে! ওরা যে পরস্পরকে পছন্দ করে তা তো কোনো দিন বুঝিনি। তবুও সুকান্তের মতো ছেলে আপনাদের অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। রমেশ চক্রবর্তী তার ব্রাহ্মণত্বের সাক্ষ্য পৈতার গোছা অনাবৃতবক্ষে বিস্তৃত করে বললেন: কারণ একটাই, সে দরিদ্র। আমার মেয়ের বিয়ে ওর সঙ্গে মেনে নিতে পারি না। তুমি আমাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা কোরো না। তুমি এখন আসতে পারো। কার্তিকের মর্মভেদ করে একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল: মেসো, আপনি আমার পিতঃসম। আপনি চলে যেতে বললে চলে যাব। কিন্তু আপনি আমাকে সকল বিষয়ে সাহায্য করেছেন, এখন আপনার কষ্টের দিনে দূরে চলে যেতে পারি না। আমি আপনাদের পাশে থাকব।রমেশ চক্রবর্তী নীরবে ভাবতে লাগলেন, একটু পরে কার্তিকের দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন: তুমিই বলো বাবা, এসব সহ্য করা যায়? সুকান্ত ভালো ছেলে। বন্ধুত্ব ছিল, সেটা থাকলেই ভালো ছিল। আমি বিশ্বাস করি ছেলে-মেয়ে সহজভাবে মেলামেশা করুক। তাই বলে বিয়ে!কার্তিক বলল: এই বিয়েতে আপত্তি করবেন না, মেসো। মাসিও একটু ভেবে দেখুন। চন্দ্রা আমার বোন। রমেশ চক্রবর্তী কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো শুয়েই রইলেন। বিমলা বললেন: না, এই বিয়ে তোমার মেসো মেনে নিতে পারেন না। গরিবের ছেলের সঙ্গে কীভাবে তিনি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারেন? তার অমতে যদি চন্দ্রা বিয়ে করে তাহলে তিনি অমন মেয়েকে ঘরে তুলবেন না। তিনি তার মেয়ের বিয়ে অক্ষয় দাসের ছেলে পার্থের সঙ্গে দিতে চান।কার্তিক ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, পার্থ?বিমলা সহজ লঘু ভঙ্গিতে বললেন: ওই যে, জমিদার বাড়ি আছে না, তার পাশের বাড়ির পার্থ।বিমলার দৃষ্টিতে অপূর্ব স্নেহময় স্পর্শ প্রকাশ পায়। কার্তিক বলল, আমি চিনি তাকে। সে তো অন্য স্থানে আবদ্ধ, সে কথা মেসো জানেন না। জেনেশুনে কীভাবে আপনি চন্দ্রার কপাল ভাঙবেন অথবা নিজের অজ্ঞাতসারে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেরই বিপদ ডেকে আনবেন!
Advertisement
বিমলার মন কিঞ্চিৎ শান্ত হলো। কিন্তু রমেশ চক্রবর্তী প্রবল ঝটিকার অবসানে শ্রান্ত পথিকের মতো হতবুদ্ধি হয়ে শোয়া অবস্থা থেকে এক ধাক্কায় শরীরটা সোজা করে বসলেন, তারপর তীব্রকণ্ঠে বললেন: কী বললে! বিশ্বাসঘাতক—হীন—কাপুরুষ!কার্তিক অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রমেশ চক্রবর্তীর দিকে। তিনি যেন পাষাণে গঠিত মূর্তি—প্রাণহীন, নিশ্চল—শুধু ওষ্ঠাধর ঈষৎ কম্পিত। এই নিশ্চল-পাষাণ মূর্তিটি দেখে কার্তিক শঙ্কিত হলো। আবেগঘন কণ্ঠে বলল: আপনার কাছে আমার অনুরোধ, অনুসন্ধান করে দেখুন, আমি যা বলছি তা সত্য কি না। আমার মন বলছে, চন্দ্রা এ-সম্বন্ধে অবগত হয়েই সুকান্তকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। থাকবও। কিন্তু আজন্ম যে মেয়েটি আমাকে দাদা বলে জানে, সেই মেয়েটি আপনাদের মন থেকে চলে যাক, সেটি আমি সহ্য করতে পারব না।কার্তিক চলে গেল, কিন্তু রমেশ চক্রবর্তীর মনের ওপর যে প্রবল আঘাত করে গেল তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। স্থিরনিস্তরঙ্গ জলে প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করলে তা যেমন তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে, রমেশ চক্রবর্তীর মনও কার্তিকের কথায় তেমনই সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। দৃঢ় অবিচলিত বিশ্বাস ছিল—পার্থ সম্বন্ধে কেউ কোনো মন্দকথা বলতে পারবে না। আজ কার্তিকের কথায় তার মনে প্রথম সংশয়ের রেখাপাত হলো। এক-একবার তার মনে হতে লাগল: কার্তিকের কথাগুলো হয়তো-বা মিথ্যা নয়। স্নেহময়ী ও কোমল হৃদয়ের চন্দ্রার দুঃখবেদনা তিনি প্রাণ দিয়ে অনুভব করতে লাগলেন।
দুঃখের সময় অতিমন্থর গতিতে অতিবাহিত হয় সত্য, তবুও সময় এগিয়ে চলে, কারো জন্য বসে থাকে না। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পথঘাট কাদাময় হয়ে উঠেছে। আজ অবশ্য আকাশে মেঘ নেই। কখনো কখনো দু-একখণ্ড শুভ্রমেঘ হাঁসের মতো গলা সরু করে উদ্দেশ্যহীনভাবে আকাশে উড়ে বেড়ায়। কখনো-বা অতীত স্মৃতির বেদনাজড়িত কান্নার মতো গগনের কোনো অনির্দেশ্য কোণে গুড়গুড় করে ওঠে কিন্তু গভীরতা লাভ করে না। চন্দ্রা সমস্ত সকাল রান্নাঘরে কাটিয়ে পুকুরঘাট থেকে স্নান সেরে ধীরমন্থর গমনে বাড়ির দিকে চলেছে। সে হাসতে ভুলে গেছে। কাঁদতেও তার বিরক্তি বোধহয় যেন। তার বিয়ের প্রসঙ্গে আর আলোচনা করতে লজ্জা বোধ করে। বাড়ি আজ সম্পূর্ণ নির্জন। রমেশ চক্রবর্তী এখনো ফিরে আসেননি। কোথায় যেন গেছেন জরুরি কাজে। রবিকে নিয়ে বিমলা গেছেন আত্মীয় বাড়িতে, ফিরবেন সন্ধ্যায়।
চন্দ্রা যখন বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; তখন তার সামনে এসে উপস্থিত হলো সুকান্ত। সুকান্ত পাড়ার ছেলে, তাই পথে-ঘাটে দেখা হওয়াই স্বাভাবিক। চন্দ্রা অবাক হলো না। সুকান্ত গম্ভীর মুখে বলল: চন্দ্রা, কী সিন্ধান্ত নিলে?চন্দ্রা প্রথমে বুঝতে পারেনি কীসের সিদ্ধান্ত! পরে বুঝতে পেরে বলল, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না! ব্যস্, এতেই সুকান্তের মাথায় আগুন ধরে গেল। আজকাল মাথায় চাপা আগুন থাকে, কোনোক্রমে একটু তেল বা ঘৃত ছিটে পড়লে দপদপ করে জ্বলে ওঠে আগুনটা। এই আগুনে জ্বলতে জ্বলতেই বলল: দ্যাখো চন্দ্রা, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসার... সেই বাল্যকাল থেকে। তোমাকে আমার চেয়ে কেউ ভালো বোঝার কথা নয়। আমাকেও তোমার চেয়ে কেউ ভালো জানে না। জীবন চলার পথে এর চেয়ে বড় ভরসা ও বিশ্বাস আর কী হতে পারে? নীরক্ত, নির্জীব ভাব নিয়ে চন্দ্রা বলল: আমি সবই বুঝি। কিন্তু আমি তো আর তোমার মতো স্বাধীন নই যে, নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি! মেয়ে হয়ে এই সমাজে বেঁচে থাকা যে কী সমস্যা তা তুমি কখনো বুঝবে না। তাড়াহুড়ো, দাপাদাপি, অবিবেচনার মানুষ সুকান্ত নয়। তার মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। বলল: জীবনের ভাঙাচোরা জীবনে আমি কখনোই কোনো নারীকে চিন্তা করিনি, করতেও পারি না, তুমি ছাড়া। আমি কখনো বলিনি, তুমি বাবার সিদ্ধান্ত অমান্য করো। আবার এও চাই না যে, তুমি আমাকে অবজ্ঞা করো।চন্দ্রার মাথা হঠাৎ গরম হয়ে যায়। অশান্ত হয়ে ওঠে। ক্রমশ ক্ষোভ দেখা দেয়। রাগ, আক্রোশ। বলল: তুমি আমাকে এভাবে দায়ী করো, তা আমি চাই না। আর নিজের ঘাড়ে দোষ নিতে পারছি না। বড্ড ক্লান্ত। সুকান্ত জানে: চন্দ্রা হাজারো রাগ করুক, মাথায় এক-আধটুকু আগুন জ্বলুক, ভেতরে ভেতরে যতই আক্রোশ থাকুক-না কেন, সে তাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তাই কপালে যতই দুর্ভাগ্য লেখা থাকুক-না কেন, চন্দ্রাকে কোনোমতেই নির্বোধ মনে করে না সে। তার কথাও অমান্য করা যায় না, তাই বলল: তাহলে বলো আমি কী করব? আমি তো তোমাকে বরণ করেই নিয়েছি। তোমাকে বিপদমুক্ত করতে যা বলবে তাই করব।ঠান্ডা গলায় চন্দ্রা বলল, আমার যত বিপদ সবই তোমাকে নিয়ে। নিজেকে স্থির করো। ধৈর্য ধরো। সময় আমাদের সঠিক পথ দেখিয়ে দেবে।সুকান্ত কেমন যেন বোকার মতো হাসল, অল্পক্ষণ চুপচাপ থাকল, অবশেষে বলল: পথ তো বেঁধেছি তোমার সঙ্গে। যেখানে তোমাকে পাওয়ার পথটি অনিশ্চিত, শঙ্কাহীন, সেখানে আমি কীভাবে স্থির থাকতে পারি?চন্দ্রা কপালের ভিজে চুল সরিয়ে নিলো, কান মুছল শাড়ির আঁচলে, জলের ভিজে ভাব ছিল লতিতে; তারপর বলল: তাহলে সময়ের কাছে ছেড়ে দাও। সময়ই বলে দেবে কী করা প্রয়োজন!
অক্ষয় দাস নিজের ঘরে নির্বাক নিস্তব্ধ বসে রয়েছেন। তিনি আজ বড্ড বিহ্বল। পার্থ নিজের ঘরে এসে গায়ে একটি হাতকাটা গেঞ্জি গলিয়ে নিলো। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অক্ষয় দাসের ডাক শুনল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। মেঘ থাকলে এই সময়টা আরও ময়লা, কালচে দেখাত। বৃষ্টির কোনো আশা নেই। অসহ্য গরম আর গুমোট ভাব। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পার্থ। আকাশে দু-একটা তারা ফুটে আছে। পার্থ তার বাবার ঘরে ঢুকে দুদণ্ড দাঁড়াল। চারপাশই ঘিঞ্জি। কেরোসিন তেল মিশ্রিত অদ্ভুত এক দমবন্ধ বাতাস যেন এ-ঘরে। মৃদুস্বরে বলল, আমাকে ডেকেছিলে? অক্ষয় দাসের তিরিক্ষি ধরনের স্বভাব, কিছুক্ষণ অধোবদনে ভেবে নিয়ে রুক্ষভাবে পার্থের উদ্দেশ্যে বললেন: পার্থ, আমারই ভুল হয়েছে। তোকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আসলে জল আর তেলে মেশে না। তুই ভুলে যা বাবা রমেশ চক্রবর্তীর মেয়ের কথা।পার্থ ব্যাপারটা ধরতে পারল না বরং আশ্চর্য হয়ে বলল: ওর কথা না-হয় ভুলে গেলাম। আমি আর বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। কিন্তু আমাদের পরিবারের প্রতি যে অপমানটা করা হয়েছে সেটি কীভাবে ভুলব? অক্ষয় দাস বৈষয়িক মানুষ, বাস্তব বুদ্ধি যথেষ্ট, তাই অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে বললেন: অপমানটা তো পণ্ডিতের চালে হয়েছে। সে জানে জাত ভুলে রমেশ চক্রবর্তী আমার সঙ্গে সম্বন্ধ করবেন না। উদ্দেশ্য ছিল মাঝখান থেকে কিছু অর্থকড়ি হাতিয়ে নেওয়া।পার্থ জেদ করতে লাগল, তাই বলে অপমানটা তুমি মেনে নেবে?অক্ষয় দাস বললেন, তাহলে কী করতে বলিস?পার্থ বলল: আমি অতশত বুঝি না বাবা, শুধু বুঝি প্রতিশোধ নিতে হবে। অর্থ থাকলে শক্তিও কেনা সম্ভব। তোমাকে সেই পথেই অগ্রসর হতে হবে। চক্রবর্তীর জাতের গরিমা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে যে, আমাদের পরিবারকে অপমান করা এত সহজ নয়। এ-ই আমার শেষ কথা।
পার্থ সামান্য সময় তার পিতার কক্ষে ছিল। তারপর রাস্তায় এসে একটি বিড়ি ধরাল। কাছেই একটা মাঠ, ধুলোর মাঠ। পার্থ সেখানে যায় না। রাস্তার পাশের চা-পানের দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সন্ধ্যার পর সেখানে ভিড় জমে ওঠে। এই পাড়ায় অনেক পুরাতন বন্ধু রয়েছে পার্থের। কে যেন পেছন থেকে ডাকল। পার্থ দাঁড়াল। পেছন ফেরতেই দেখল শতদল একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পার্থ এগিয়ে গেল। বলল, তুই! কী রে? মাল খেয়েছিস নাকি! গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলি। খেয়াল করিনি।করবি। পরিমলের মতো বিপদে পড়লে করবি।পরিমল কে?তুই চিনবি না। আমার এক বন্ধু। তার যখন বিপদ আসে; তখন আমি ছাড়া তার কেউ নেই। সাবধানে চলাফেরা করবি। নিজের দিকে চোখ রেখে চলবি, বুঝলি!শতদল হাসল। কিছুটা বেদনাও ছিল হাসিতে। কোথায় যাচ্ছিস?পরিমলের কাছে। ওই-যে বললাম, বিপদ এলে সে আমাকে স্মরণ করে। তাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি।কীরকম বিপদ?মারামারি আর কি!আছিস কেমন?ভালো নেই। অনেক আর্থিক ঝঞ্ঝাটে আছি। তাই যাচ্ছি অর্থের বিনিময়ে পরিমলের হয়ে মারামারি করার জন্য।পার্থ সামান্য অবাক হয়ে শতদলকে দেখল। তারপর বলল, তুই একদিন আমাদের বাড়িতে আয়। শতদল একটু হেসে বলল, খ্যাপ আছে বুঝি? তা আমি করে দিতে পারব। তবে অর্থ ছাড়া হবে না। তুই আয়। তখন কথা হবে। শতদল মাথা নাড়ল। তারপর এগিয়ে গেল রাস্তা ধরে।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৮ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৯ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১০ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১১ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১২এসইউ/জিকেএস