সফলতা অর্জন করার পথে ব্যর্থতা প্রায়ই আমাদের সঙ্গী হয়। আমরা সবাই শুনে এসেছি, "Failure is the pillar of success"— অর্থাৎ ব্যর্থতাই হলো সাফল্যের স্তম্ভ। কিন্তু এই কথার মর্মার্থ বুঝতে অনেকেই ব্যর্থ হন। ব্যর্থতা আসলে আমাদের শেখার সুযোগ দেয়, আমাদের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে এবং উন্নতি করার পথ তৈরি করে। তবে ব্যর্থতার কারণগুলো সঠিকভাবে না বোঝা গেলে, তা আমাদের জীবনে পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তাই সফল হতে হলে প্রথমে ব্যর্থতার কারণগুলো সনাক্ত করা জরুরি।
Advertisement
প্রত্যেক সফল ব্যক্তির জীবনে লক্ষ্য নির্ধারণের গুরুত্ব অপরিসীম। আপনার যদি কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকে, তবে আপনি কোথায় পৌঁছাতে চান তা কখনোই স্পষ্ট হবে না। লক্ষ্যহীনভাবে চললে আপনি কোনো দিকে অগ্রসর হবেন না। ফোর্বস এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, "যেসব ব্যক্তি তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করেন না, তারা জীবনের ৭০% ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন" (2020)। সাফল্যের জন্য প্রথম ধাপ হলো একটি স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ঠিক করা।
আমাদের মধ্যে অনেকেই জীবনের বিভিন্ন সময়ে এমন অবস্থায় পড়ি যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য অস্পষ্ট থাকে। এটি একটি বড় সমস্যা কারণ এটি সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি কমিয়ে দেয়। ফলে আমরা পরিশ্রম করলেও ফলাফল অর্জন করতে ব্যর্থ হই। সফল ব্যক্তিদের জীবনে লক্ষ্য নির্ধারণের উদাহরণ রয়েছে, যেমন স্টিভ জবস তার জীবনের একটি স্পষ্ট লক্ষ্য স্থির করেছিলেন— "বিশ্বকে আরও সহজ প্রযুক্তি সরবরাহ করা।" তার সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যই তাকে বিশ্বের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা হতে সাহায্য করেছে।
দ্বিতীয় কারণ: শৃঙ্খলা এবং মনোযোগের অভাব (Lack of Focus and Discipline)সাফল্য অর্জনের জন্য যে মনোযোগ ও শৃঙ্খলা দরকার, তা অনেক সময় আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, "নিয়মিত অনুশীলন এবং শৃঙ্খলা অনুসরণকারী ব্যক্তিরা তাদের জীবনের ৮৫% ক্ষেত্রে সফল হন" (Harvard Business Review, 2019)। তবে যারা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, তারা সাফল্যের পথে বারবার বাধার সম্মুখীন হন।
Advertisement
প্রতিদিন আমাদের জীবন পরিবর্তনশীল। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে, তবে সেগুলোকে মোকাবিলা করার মানসিক শক্তি অর্জন করাই হলো সফলতার আসল পরীক্ষা। তাই ব্যর্থতার ভয় ত্যাগ করে নতুন কিছু শেখার মনোভাব তৈরি করুন এবং নিজের লক্ষ্যগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে সামনে এগিয়ে যান।
শৃঙ্খলার অভাব আমাদের প্রতিদিনের কাজকর্মকে প্রভাবিত করে, যার ফলে সময় নষ্ট হয় এবং লক্ষ্য থেকে সরে আসা সহজ হয়। প্রতিদিন কিছু নির্দিষ্ট অভ্যাস গড়ে তুললে এবং সেই অভ্যাসগুলোর প্রতি নিবেদিত হলে আমরা সাফল্যের পথে অনেক দূর এগোতে পারি। মনোযোগের অভাবও একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। আমরা যদি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দিকে মনোযোগ দিতে থাকি এবং একটি নির্দিষ্ট কাজ বা উদ্দেশ্যের প্রতি মনোনিবেশ না করি, তাহলে সফল হওয়া কঠিন।
তৃতীয় কারণ: সীমাবদ্ধ মানসিকতা (Limited Mindset)আমাদের মানসিকতার সীমাবদ্ধতা আমাদের সফলতার পথে বড় বাধা হতে পারে। অনেক সময় আমরা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে আটকে থাকি, যেখানে আমরা নতুন কিছু ভাবতে বা শেখার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলি। এই সীমাবদ্ধ মনোভাবের কারণে আমরা "out-of-the-box" চিন্তা করতে ব্যর্থ হই এবং সাফল্যের নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করতে অক্ষম হই।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, "যেসব মানুষ নতুন ধারণা ও চিন্তার প্রতি খোলা মন রাখেন, তারা তাদের জীবনে ৬০% ক্ষেত্রে সফল হন" (2018)। উদ্ভাবনী চিন্তা এবং নতুন কিছু শেখার মানসিকতা সাফল্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এমনকি থমাস এডিসন যেমন বলেছিলেন, "আমি ব্যর্থ হইনি, আমি কেবল এমন ১০,০০০ উপায় খুঁজে পেয়েছি যা কাজ করে না।" তার এই উদ্ভাবনী মানসিকতা তাকে শেষ পর্যন্ত সফল করে তুলেছিল।
Advertisement
সীমাবদ্ধ মানসিকতা আপনাকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে আটকে রাখে এবং আপনাকে ব্যর্থতার পথে চালিত করে। তাই, এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং নিজের চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করা সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চতুর্থ কারণ: ব্যর্থতার ভয় (Fear of Failure)আমরা অনেক সময় ব্যর্থতার ভয়ে চেষ্টা করতে পিছিয়ে যাই। কিন্তু ব্যর্থতা আসলে শেখার একটি মাধ্যম। যারা ব্যর্থতাকে ভয় পায়, তারা প্রায়ই সেই ভয়ের কারণে কোনো কিছু চেষ্টা করতে সাহস করে না এবং এর ফলে সফলতা থেকে দূরে থাকে।
ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, "যেসব ব্যক্তি ব্যর্থতার ভয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে ভয় পায়, তাদের জীবনে সাফল্যের হার মাত্র ২০%" (2020)। ব্যর্থতার ভয় আমাদের সুযোগগুলো থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাই, ব্যর্থতাকে একটি শেখার প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করা জরুরি।
উদাহরণ হিসেবে, বিশ্বখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় মাইকেল জর্ডান বলেছিলেন, "আমি আমার জীবনে বারবার ব্যর্থ হয়েছি, আর তাই আমি সফল হয়েছি।" তার এই মানসিকতা তাকে বিশ্ববাসীর অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হতে সাহায্য করেছে।
ব্যর্থতা জীবনের একটি অংশ, তবে তা থেকে শেখার ক্ষমতা সফলতার মূল চাবিকাঠি। আপনার ব্যর্থতার পেছনের কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলে আপনি সহজেই সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে পারবেন। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ, শৃঙ্খলা ও মনোযোগ বজায় রাখা, সীমাবদ্ধ চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা এবং ব্যর্থতার ভয় কাটিয়ে ওঠা— এগুলোই হলো সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রতিদিন আমাদের জীবন পরিবর্তনশীল। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে, তবে সেগুলোকে মোকাবিলা করার মানসিক শক্তি অর্জন করাই হলো সফলতার আসল পরীক্ষা। তাই ব্যর্থতার ভয় ত্যাগ করে নতুন কিছু শেখার মনোভাব তৈরি করুন এবং নিজের লক্ষ্যগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে সামনে এগিয়ে যান।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
এইচআর/এএসএম