মতামত

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অন্তর্বর্তী সরকার

বাংলাদেশ জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে আমরা জাতিগত দাঙ্গা, ধর্মীয় সম্প্রদায়গত দাঙ্গা দেখেছি। কিন্তু আমাদের দেশে এমন ঘটনা কখনই ঘটেনি। ছোট দুএকটি ব্যক্তি দ্বন্দ্বকে তিল থেকে তাল বানানোর চেস্টা হয়েছে। কিন্তু তা কখনই সফল হয়নি। এর কারণ, জাতি হিসেবে আমরা কখনই এসবের সাথে পরিচিত নই।

Advertisement

আমাদের এই সম্প্রীতির বন্ধন অনেক দেশি - বিদেশীর কাছে বিষণ ইর্ষণীয়। তারা বিভিন্নভাবে নানা রকমের গুজব ছড়িয়ে এই সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চাইছে। চাইছে আমাদের সরকারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্কিত করতে। কিন্তু সরকারের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকরাও এ বিষয়ে দারুণ সচেতন।

আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য চলে আসছে। মাঝে মধ্যে কিছু দুষ্টুচক্র আমাদের এই সম্পর্কে ফাটল ধরানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছে, এখনও চালাচ্ছে। তবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে আমরা এই দুর্বৃত্তদের কালো হাত ভেঙে দিতে পারব।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের স্বার্থে দেশি বিদেশী চক্রান্তের দিকে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বিভিন্ন ধরনের জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সহাবস্থানই এ দেশের বৈশিষ্ট্য।

Advertisement

সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক, নারী নির্যাতন সব ধর্মেই নিষিদ্ধ; সব ধর্মেই এগুলোকে প্রতিহত করার বয়ান রয়েছে। আমরা এই বয়ানগুলোতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসায় আমরা সিক্ত হতে পারি। সম্প্রীতি আছে, বিভাজনও আছে। আমাদের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমরা জানি, বর্তমান সরকার রাজনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে দেশ পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে সুসজ্জিত ফুলবাগানের মত। বাগানে নানা ধরনের ফুল থাকলে বাগানের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। এটাই হচ্ছে বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে বহুত্ববাদী সমাজে নানা ধর্মের লোক থাকবে।

রাতের আঁধারে কেউ উপাসনালয় অপবিত্র করতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে, এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই। অতিমাত্রায় দলবাজি করে কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হামলা করে তবে তা তো সাম্প্রদায়িক ব্যাপার নয়। এটি তো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বৈশ্বিক মিডিয়াকে এই বিষয়টিকে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে হবে।

সম্প্রীতি শব্দের অর্থ সমপ্রীতি বা সহাবস্থান, যা মানব জাতির আদিকাল থেকেই বিরাজমান। মানব ইতিহাসের শুরুটা ধর্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ না থাকলেও মানবসেবাকে ধর্ম বিবেচনা করা হতো বলে ধারণা করা হয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা বংশপরম্পরায় যা লালনপালন করে আসছে। সৃষ্টিতত্ত্বে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নেই। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এটি সম্প্রীতির মূলমন্ত্র।

Advertisement

সংস্কৃতির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সম্প্রীতি একমাত্র শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, যা সকল অশুভ শক্তিকে একতাবদ্ধ হয়ে পরাজিত করেছে। আর এই মানুষে মানুষে একতাবদ্ধ হওয়ার অপর নাম সম্প্রীতি। আমাদের নীতি-দর্শনে সম্প্রীতির যে বীজ বপন করা ছিল, তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নষ্ট করার প্রয়াস চালায় কিছু মানবতাবিরোধী শক্তি। হীন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। যার আসল উদ্দেশ্য প্রগতির পথ রুদ্ধ করা, সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করা। এতে হীন স্বার্থান্বেষীরা লাভবান হয় বটে কিন্তু জাতির আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

রাজনীতি ও সমাজনীতিতে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের বিভক্তিকরণের মাধ্যমেই জন্ম হয় সাম্প্রদায়িকতার। শুরু হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল গোত্র-বর্ণ ও জাতির ওপর সবল গোত্র-বর্ণ ও জাতির আধিপত্যের লড়াই। যার মাধ্যমে বিনষ্ট হয় মানুষের সভ্য, সুস্থ ও শান্তিময় জীবন। সাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতার বিপক্ষে উপ্ত এক বিষবৃক্ষ। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। পৃথিবীর সকল ধর্মের মূল কথা প্রেম, শান্তি, মৈত্রী ও সম্প্রীতি। ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক প্রগাঢ়। কারণ, প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিকতা বিদ্যমান। স্বাধীনতা, সৃষ্টিশীলতা, জ্ঞান, সততা, প্রেম, বন্ধুত্ব, করুণা, পরার্থপরতা ও আপন আদর্শ অনুযায়ী বাঁচার সাহস এসবকেই মানুষ মূল্যবান মনে করে। আর এই সমষ্টিগত গুণের ধারকই সমাজে মূল্যবান হয়ে ওঠে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যাপক বিকাশ দরকার। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্ক বজায় না রেখে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। জাতীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তাই অপরিহার্য।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের স্বার্থে দেশি বিদেশী চক্রান্তের দিকে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বিভিন্ন ধরনের জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সহাবস্থানই এ দেশের বৈশিষ্ট্য।

সংবিধানেও দেশের প্রতিটি নাগরিকের ধর্মপালন, ব্যবসা, রাজনীতি, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে সমানাধিকারের কথা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের সম্পর্ক বিনষ্টের জন্য কিছু কায়েমি-স্বার্থবাদী দুষ্কৃতকারী অপচেষ্টা চালায়। তাদের প্রতিহত করার জন্য সরকার সজাগ আছে। আমাদেরও সজাগ এবং সচেতন থাকতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম