মতামত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: বন্ধুত্ব ও খবরদারির তর্ক

রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এমনকি জনপরিসরেও ভারতবিরোধিতা তীব্র হয়েছে— যেটি দৃশ্যমান ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন দেওয়াল চিত্রেও।

Advertisement

‘বয়কট ভারত’ কিংবা ‘ভারতবিরোধিতা দেশপ্রেমের অংশ’—এরকম স্লোগানও চোখে পড়েছে। ৫ আগস্ট থেকে এই বিরোধিতা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। কেননা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের বিরাট অংশই মনে করে বা বিশ্বাস করে যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করে শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন মূলত ভারতের আশীর্বাদে। তার আমলে ভারত এই দেশকে তাদের অঙ্গরাজ্য হিসেবে বিবেচনা করেছে— এমন কথাও জনপরিসরে শোনা যায়।

জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন এখানে ভারতের সৈন্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে বা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এখানে ভীষণ সক্রিয় ছিল— এমন কথাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন, অসংখ্য মানুষ এটি বিশ্বাস করেছে বা এখনও করে। এসব কারণে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখানে ভারতবিরোধিতা আরও প্রবল হয়েছে—যার সবশেষ বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশের একাধিক স্থানে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ভারতের পতাকার নকশা এঁকে সেটি মাড়িয়ে যাওয়া। এর পাল্টা হিসেবে কলকাতায়ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটেছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দিয়ে বিভিন্ন মন্দির, মসজিদ ও মাজারে হামলা-ভাঙচুর। বিশেষ করে ভারত তথা সে দেশের সরকার ও গণমাধ্যমের একটি অংশ বলার চেষ্টা করছে যে, বাংলাদেশে হিন্দুরা নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের পরে জল আরও ঘোলা হয়। চিন্ময়কে মুক্তি না দিলে সীমান্ত ঘেরাওয়েরও হুমকি দেয় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। সব মিলিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, সেটি কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়। প্রশ্ন হলো, এই টানাপোড়েন কি শেষমেশ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করবে? যদি সেটি নাও হয় তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কি ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের মতো একটা দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা তৈরি হবে?

Advertisement

গণমাধ্যমের খবর বলছে, বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর কলকাতার মানিকতলা এলাকার জেএন রায় হাসপাতাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশে ভারতীয় পতাকার অবমাননা এবং দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এর আগে ভারতের জাতীয় পতাকা অবমাননার প্রতিবাদে বাংলাদেশি রোগী দেখা বন্ধ করেন প্রখ্যাত ভারতীয় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল সাহা। এরপর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার একটি হাসপাতালও বাংলাদেশি রোগী দেখবে না বলে ঘোষণা দেয়।

ভারতে বাংলাদেশের রোগীরা না গেলে তাতে ভারতের মেডিকেল ট্যুরিজমই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। যেমন বাংলাদেশি পর্যটকের অভাবে কলকাতার নিউমার্কেটের ব্যবসায় লালবাতি জ্বলার উপক্রম হয়েছে—এমন খবরও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে এই সম্পর্কের টানাপোড়েনের পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সীমান্ত সমস্যা, পানিবণ্টন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু কারণও রয়েছে। যেমন:

১. তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে মূলত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণে। এই চুক্তি কার্যকর না হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের মনে ক্ষোভ আছে। তিস্তা ছাড়াও গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ভারত আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির তোয়াক্কা করে না বলে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত—এটিও নির্মম সত্য।

Advertisement

২. বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনাও দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি বিরাট দেওয়াল। বিশেষ করে গরু চোরাচালান এবং মানবপাচার নিয়েও উভয় দেশের মধ্যে বিবাদ রয়েছে।

৩. ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি অনেক বেশি, কিন্তু রপ্তানি কম। এই বৈষম্য অর্থনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে।

৪. বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

৫. চীন ও ভারতের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা এই সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে।

ভারত যদি বাংলাদেশকে তার একটি বাজার কিংবা তার কোনো রাজ্যের মতো মনে করে, সেটি বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে না। ভারতের এই আত্মজিজ্ঞাসাটা জরুরি যে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে দারুণ অবদানের পরেও এই দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর ভেতরে যে ভারতবিরোধী মানসিকতা প্রবল হচ্ছে, সেখানে তার নিজের দায় কতটুকু?

৬. মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধানে ভারতের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। বাংলাদেশ আশা করেছিল ভারত এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু ভারতের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ হওয়ায় এই বিরাট সংকট সমাধানে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না।

৭. মুখের কথায়ও অনেক সময় সম্পর্ক নষ্ট হয়। কোনো উগ্রবাদী বা কট্টরপন্থি দলের নেতারা যে ভাষায় কথা বলেন, সেই একই ভাষায় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা কথা বলেন না। বলতে পারেন না।

বাস্তবতা হলো, প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ করে বা সম্পর্ক খারাপ করলে তার মাশুল দিতে হয় উভয়কেই। অন্যদিকে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকলে তৃতীয় পক্ষ বা তৃতীয় কোনো শক্তিশালী দেশ প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ওপরই নাক গলানোর সুযোগ পায় না। উপরন্তু প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক সম্মান ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলে প্রত্যেকেই অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকতে পারবে— এমন চিন্তা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট গড়ে তোলা হয়।

এ মুহূর্তে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যে আন্তঃসম্পর্ক ও যোগাযোগ, সেটি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্কের একটি বড় উদাহরণ। একই ভিসায় ২৫টির বেশি দেশ ভ্রমণের সুযোগ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জনগণের মধ্যে সম্পর্ক যেমন উন্নত করেছে, তেমনি রাষ্ট্রসমূহের ঐক্য তাদের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় বড় ভূমিকা রাখছে।

একই ধরনের চিন্তা থেকে সার্ক গঠন করা হলেও মূলত এই প্রতিষ্ঠানটি কখনোই খুব শক্তিশালী আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তার পেছনে বড় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের খবরদারি করার প্রবণতা এবং সবখানে নিয়ন্ত্রণ তথা আধিপত্যকামী মানসিকতাও যে অনেকখানি দায়ী, সেটি বোধহয় ভারতের রাজনীতিবিদরাও স্বীকার করবেন। অথচ সার্ককে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির অনেক দরজাই খুলে যেতে পারতো। ইউরোপের মতো সার্কভুক্ত দেশের মানুষ যদি একই ভিসায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং তার সঙ্গে আফগানিস্তান ভ্রমণের সুযোগ পেতেন, তাহলে সব দেশের পর্যটন ও মেডিকেল ট্যুরিজম বিকশিত হতে পারত।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সাথে সাক্ষাৎকালে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রধান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসও।

বলা হয়, প্রতিবেশী ভালো না হলে শান্তিতে ঘুমানো যায় না। আবার এও ঠিক যে, পারস্পরিক সম্পর্ক একপাক্ষিক হয় না। সম্পর্ক মানেই সেটি দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক। একপক্ষ বন্ধুত্ব চাইবে, আরেক পক্ষ চাইবে খবরদারি—সেটি সম্পর্কের অন্তরায়। বন্ধুত্বের মধ্যে থাকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আস্থা। উঁচু-নিচু, বড়-ছোট তথা ক্ষমতার বাহাদুরি দিয়ে বন্ধুত্ব হয় না। এই বাস্তবতাটি বড় রাষ্ট্রগুলোকে বুঝতে হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরাসরি সহযোগিতা না দিলে এই যুদ্ধটি আরও দীর্ঘায়িত হতো—সে বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। ভারত তার নিজের স্বার্থে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়েছে, এই ন্যারেটিভ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তবতা হলো ভারতের সেই স্বার্থটি বাংলাদেশেরও পক্ষে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত। একদিকে বঙ্গোপসাগর। ভারত প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। তার আয়তন বাংলাদেশের প্রায় ১০ গুণ। নানা কারণেই বাংলাদেশের তুলনায় তার শক্তি বেশি। অতএব তার সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ নয়। আবার বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে আখেরে ভারতও খুব বেশি লাভবান হবে না। কারণ ভারতের অভ্যন্তরেই নানা সংকট রয়েছে। বিশেষ করে সেভেন সিস্টার্সের অস্থিরতা তাকে প্রতিনিয়তই ভোগায়। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক তথা বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা তার জন্যও জরুরি। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে তারও উচিত বাংলাদেশ এবং এখানের জনগণকে সম্মান করা। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে সমীহ করা।

ভারত যদি বাংলাদেশকে তার একটি বাজার কিংবা তার কোনো রাজ্যের মতো মনে করে, সেটি বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে না। ভারতের এই আত্মজিজ্ঞাসাটা জরুরি যে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে দারুণ অবদানের পরেও এই দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর ভেতরে যে ভারতবিরোধী মানসিকতা প্রবল হচ্ছে, সেখানে তার নিজের দায় কতটুকু?

পরিশেষে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রশ্নে আক্রমণাত্মক ও উসকানিমূলক ভাষা পরিহার করা জরুরি। অনেক শক্ত ও কঠিন কথা যুক্তিপূর্ণ ভাষায় বলা যায়। যুদ্ধের বিকল্প সব সময়ই আলোচনা এবং আলোচনা মানেই হলো কথা। কিন্তু যুক্তির চেয়ে আক্রমণ এবং অন্যের চেয়ে নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ করার মানসিকতা প্রকাশ পেলে আলোচনা ভেস্তে যায়। সম্পর্ক নষ্ট হয়। এটা আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগে যেমন, তেমনি আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগেও।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক