অর্থনীতি

বাজেটের অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় করতে হবে

 

সরকারের অগ্রাধিকার খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো পদ্ধতির আওতায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সুষ্ঠু ও সময়মত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশোধিত বাজেট প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

Advertisement

এ লক্ষ্যে সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলনের নীতিমালা করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখানে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটর বরাদ্দ করা অর্থ কিভাবে ব্যয় হবে তার দিক-নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব ও মূলধন প্রাপ্তির সংশোধিত প্রাক্কলনের পদ্ধতিরও দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের পদ্ধতিও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন অবশ্যই মূল বাজেটে প্রদর্শিত মোট ব্যয়সীমার (পরিচালন ও উন্নয়ন) মধ্যে সংকুলানযোগ্য হতে হবে। কোনোভাবেই অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করা যাবে না। অনুমোদিত মূল বাজেটে প্রদর্শিত মোট উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে কোনো অর্থ অব্যয়িত থাকবে বলে অনুমান করা গেলে ওই অব্যয়িত অর্থ কোনোভাবেই পরিচালন বাজেটে স্থানাস্তর করা যাবে না।

সংশোধিত বাজেট প্রণয়ের লক্ষ্যে এসব দিক-নির্দেশনা ঠিক করে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে আগামী ২৮ নভেম্বরের মধ্যে পরিচালন বাজেটের সংশোধিত প্রাক্কলনগুলো অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগগুলোতে জমা দিতে বলা হয়েছে।

Advertisement

গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।

এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে দেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাস পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের উদ্যোগ নিলো অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থনীতি গতিশীল করা ও মূল্যস্ফীতি কমাতে চলতি অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের পরিকল্পনা এক লাখ কোটি টাকার মতো কমানো হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। 

সূত্রটি জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়। তবে নানা কারণে অর্থ বছরের সাড়ে ৫ মাস চলে গেলেও মূল্যস্ফীতির চাপ রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতি বিভিন্ন ব্যয় কমিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো এবং অর্থনীতি গতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাজেট সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং আওতাধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর সংশোধিত পরিচালনা ও উন্নয়ন বাজেট প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে কিভাবে অর্থ ব্যয় করতে হবে তা ঠিক করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

Advertisement

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিচালন এবং উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিদ্যুৎ, পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট এবং গ্যাস ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। পরিচালন বাজেটের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ছাড়া নতুন আবাসিক ভবন, অনাবাসিক ভবন এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে চলমান নির্মাণকাজ ন্যূনতম ৭০ শতাংশ শেষ হয়ে থাকলে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা যাবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সব ধরনের যানবাহন ক্রয় (মোটরযান, জলযান, আকাশযান) খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে পরিচালন বাজেটের আওতায় ১০ বছরের বেশি পুরোনো যানবাহন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে অর্থ ব্যয় করা যাবে।

এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ খাতে পরিচালন বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় অধিগ্রহণ কার্যক্রমের সব আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন করে অর্থ বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যয় করা যাবে। উন্নয়ন বাজেটের আওতায় পরিকল্পনা কমিশনের অনুকুলে ‘বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা’ খাতে জিওবি বাবদ সংরক্ষিত এবং মন্ত্রণালয়, বিভাগের অনুকুলে ‘থোক বরাদ্দ’ হিসেবে সংরক্ষিত জিওবি’র সম্পূর্ণ অংশ অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে ব্যয় করা যাবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারের নিজস্ব অর্থে সব প্রকার বৈদেশিক ভ্রমণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশগ্রহণও বন্ধ থাকবে। তবে অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনায় সীমিত আকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে অর্থ বিভাগ থেকে গত ৪ জুলাই জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে।

রাজস্ব ও মূলধন প্রাপ্তির সংশোধিত প্রাক্কলন পদ্ধতি

চলতি অর্থবছরের রাজস্ব ও মূলধন প্রাপ্তির সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে বিগত দুই অর্থবছরের (২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪) প্রথম ছয় মাসের এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪-৫ মাসের রাজস্ব আদায়ের ধারা বিবেচনা করতে বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয় এব তার ভিত্তিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধিত প্রাক্কলন প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। এরইমধ্যে কোনো আইটেমের আদায়ের হার বৃদ্ধি করা হয়ে থাকলে পুনর্নির্ধারিত হারে সম্ভাব্য অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে বলা হয়েছে এবং প্রস্তাবিত প্রাক্কলনে এর প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।

পরিচালন ব্যয়ের সংশোধিত প্রাক্কলন পদ্ধতি

 মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশোধিত পরিচালন ব্যয়ের জন্য কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-

 >> সাধারণভাবে গত দুই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম চার-পাঁচ মাসের প্রকৃত ব্যয়ের ধারার ভিত্তিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত প্রাক্কলন তৈরি করতে হবে।

 >> বেতন-ভাতা খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের প্রকৃত ব্যয়ের ভিত্তিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত প্রাক্কলন প্রস্তুত করতে হবে।

 >> চলতি অর্থবছরে অর্থ বিভাগের বাজেটের অধীনে ‘অপ্রত্যাশিত ব্যয় ব্যবস্থাপনা’ খাত থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ করা থাকলে সংশোধিত বাজেটে এর প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।

  >> অর্থ বিভাগের অনুমোদনে অথবা মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থার অর্পিত ক্ষমতাবলে কোন অর্থ পুনঃউপযোজন করা হয়ে থাকলে সংশিাধিত বাজেটে সংশ্লিষ্ট কোডে পুনঃউপযোজন করা অর্থের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।

 >> অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে এরইমধ্যে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থার অনুকুলে ‘সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের থোক’ থেকে কোন আইটেম, অর্থনৈতিক কোডে বরাদ্দ করা হয়ে থাকলে সংশিাধিত বাজেটে সংশ্লিষ্ট কোডে এর প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।

এডিপি

সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নে ১৩ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা সীমিত রাখা, মূল সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দহীন কোনো প্রকল্প না রাখা, সরকারের কৌশলগত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে অগ্রাধিকার বাছাই করে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেওয়া এবং সংশোধিত এডিপির মূল অংশে বরাদ্দবিহীন কোনো প্রকল্প না রাখা।

এছাড়া ধীরগতির প্রকল্প থেকে বরাদ্দ কমিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন গতির গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে বলা হয়েছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা-উত্তর পুনর্বাসন সম্পর্কিত প্রকল্প অগ্রাধিকার পাবে। বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প এবং চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এমন সব প্রকল্প সংশোধিত এডিপিতে অগ্রাধিকার পাবে। অননুমোদিত কোনো কর্মসূচি বা স্কিমের জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা যাবে না। বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের ক্ষেত্রে পিএলজি/জি অংশে সম্পূর্ণ ব্যয় করা যাবে এবং সেক্ষেত্রে জিওবি অংশে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান রাখতে হবে।

এমএএস/এসআইটি