বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক চরম সংকটের সম্মুখীন, যেখানে ব্যাংকখাত নগদ প্রবাহ সংকট এবং অপ্রদর্শিত ঋণের চাপে ভুগছে। এই সংকটের ফলে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার বড় ধরনের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে অনেকেই ভীত হয়ে তাদের অর্থ তুলে নিচ্ছেন। সাধারণত অর্থ মুদ্রণকে সতর্কতার সাথে দেখা হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি ব্যাংকখাতকে সংকট থেকে উত্তরণের এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। একই সাথে সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া গেলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে এবং পাশাপাশি কঠোর মুদ্রানীতির প্রয়োজনও হ্রাস পেতে পারে।
Advertisement
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতির পথে আছে, যার আওতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ১০ শতাংশ নীতির হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই নীতি কিছুটা মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়ক হলেও ঋণ গ্রহণকে ব্যয়বহুল করেছে, যা ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলেছে এবং সামগ্রিক বিনিয়োগের প্রবাহে প্রভাব ফেলেছে। ফলে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে এবং ব্যবসা চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। এই কঠোর নীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর হলেও অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, বিশেষত যখন ব্যাংকখাতে আস্থার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, ব্যাংকখাতে আস্থার চরম অবনতি ঘটেছে, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কিছু ব্যাংকের দেউলিয়াত্বের আশঙ্কার কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন। গণমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং অনেকেই বিশেষত দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে বড় পরিমাণে অর্থ তুলে নিতে শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে অসংখ্য আমানত স্কিম এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয় হিসাব বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর জন্য বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত নগদ প্রবাহ না থাকলে আমানতকারীরা অর্থ তুলে নিতে থাকবেন, যা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেবে এবং একটি অর্থনীতিকে আরও চাপের মুখে ফেলবে, যা ব্যাংকখাতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
Advertisement
যদিও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা যৌক্তিক, তথাপি নিষ্ক্রিয়তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত অর্থ মুদ্রণ ব্যাংকগুলো নগদ প্রবাহের সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হতে পারে এবং ঋণের জন্য ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে পারে। মুদ্রণ করা অর্থের মাধ্যমে প্রায় ২৫হাজার থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকখাতে প্রবাহিত করা হলে এটি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্থিতিশীল করতে সহায়ক হবে এবং মূল্যস্ফীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না।
প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে চলে গেছে, যা সামগ্রিক অর্থের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় নতুন অর্থ মুদ্রণ করে সেই ঘাটতি পূরণ করা হলে এটি দুর্বল ব্যাংকগুলো সমর্থন জোগাবে এবং মূল্যস্ফীতির ওপর সীমিত প্রভাব ফেলবে। একবার আস্থা ফিরে এলে, বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে ধীরে মুদ্রানীতি শক্তিশালী করতে পারবে, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং যুক্তরাজ্য অর্থ মুদ্রণের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিকে সহায়তা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ‘কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং’ নীতির আওতায় বিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে ঢুকিয়েছিল, যা অর্থের প্রবাহ বাড়াতে এবং ব্যবসাগুলো সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একইভাবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে ভারত কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে সীমিত অর্থ মুদ্রণ নীতি প্রয়োগ করে তাদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রেখেছিল। বাংলাদেশও এ ধরনের নীতি গ্রহণ করতে পারে, যা দেশের বর্তমান প্রয়োজন অনুযায়ী উপযোগী হবে।
লক্ষ্যযুক্ত অর্থ মুদ্রণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের সমন্বিত কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও অর্থনৈতিক অবনতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে পারে। এ পন্থা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সহায়ক হবে।
Advertisement
অর্থ মুদ্রণের পাশাপাশি, সরবরাহ শৃঙ্খলা শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বাংলাদেশে সরবরাহ শৃঙ্খলার ব্যাঘাতের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং দাম বেড়েছে। লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবহন ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালু রাখা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সুনিশ্চিত করলে মূল্যস্ফীতির চাপে লাগাম টানা সম্ভব হবে। ফলে কেবল মুদ্রানীতি কঠোর করার প্রয়োজন কমে আসবে। বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নত করা হলে এটি ভোক্তাদের জন্য দাম কমাতে সহায়ক হবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। এই কৌশলটি মূল্যস্ফীতির মূল কারণগুলোতে প্রভাব ফেলবে এবং মুদ্রানীতির ওপর বেশি চাপ না ফেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করবে।
যদি বাড়তি নগদ প্রবাহ নিশ্চিত না করা হয়, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও গভীর খাদের মুখে পড়তে পারে। ব্যাংকগুলো যখন আমানত ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন ব্যবসাগুলো বিনিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতির কারণে সীমিত নগদ প্রবাহ আমদানির ওপর প্রভাব ফেলে, যা বিভিন্ন শিল্পকে প্রভাবিত করে। ইতোমধ্যে, ডলার সংকট এবং আমদানি করা পণ্যের মূল্যস্ফীতির কারণে হাজারো কারখানা এবং ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আরও অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হারানো, আয় কমে যাওয়া এবং অর্থনৈতিক মন্দা একটি চক্রে রূপ নিতে পারে।
বাংলাদেশে বিশেষ করে যে খাতগুলো সহজে অর্থের প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোতে কর্মসংস্থান সংকটে পড়ছে কারণ ব্যাংকগুলো তহবিল সংকটের কারণে ঋণ প্রদানে হ্রাস করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি স্থবির হয়ে পড়েছে এবং ব্যবসাগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হ্রাস করছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে পারে কারণ মানুষ চাকরি হারাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক সুযোগ কমে আসছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসা (এসএমই) বর্তমানে বিশেষভাবে সংকটে রয়েছে। অর্থের প্রবাহ সংকুচিত হওয়ায় ব্যাংকগুলো এই ব্যবসাগুলোর জন্য ঋণ প্রদানে অক্ষম হচ্ছে। যদি এসএমইগুলো অর্থ সংগ্রহ করতে না পারে, তবে এর প্রভাব অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে পড়বে—চাকরি হারানো, আয় কমে যাওয়া এবং অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের অবনতি।
ব্যাংকগুলো এসএমই এবং বড় শিল্পগুলোর জন্য সমর্থন প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি নমনীয় পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আইএমএফ-শৈলীর নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষামূলক অবস্থান দেশের অনন্য অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে মানানসই নাও হতে পারে। অনেক পশ্চিমা অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাংকখাত জনগণের ভাবনা ও আবেগ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়।
সাম্প্রতিক আমানত উত্তোলনের ঢেউ প্রমাণ করে যে মানুষের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস দুর্বল। এককভাবে মুদ্রানীতির ওপর মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজন এমন একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি, যা বাংলাদেশের বর্তমান আর্থিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে সহায়ক।
নিয়ন্ত্রিত অর্থ মুদ্রণের মাধ্যমে নগদ প্রবাহ নিশ্চিত করা হলে এটি ব্যাংকগুলোকে দ্রুত সমর্থন দিতে পারবে এবং আমানতকারীদের আশ্বস্ত করবে। পাশাপাশি, সরবরাহ শৃঙ্খলা সমস্যার সমাধানের জন্য সম্পদ বিনিয়োগ করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে এবং অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ফিরে পাবে।
লক্ষ্যযুক্ত অর্থ মুদ্রণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের সমন্বিত কৌশলটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান হতে পারে। অর্থ সরবরাহ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলার অকার্যকারিতা দূর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকখাতে জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং ব্যবসাগুলো সমর্থন করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এই পন্থায় বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতিকে স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত না করেই এটি পরিচালনা করতে পারবে।
স্থায়ী ভবিষ্যতের জন্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোযোগ একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে থাকতে হবে যেখানে আস্থা, স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা হবে। নিয়ন্ত্রিত অর্থ মুদ্রণ, সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের সাথে মিলিয়ে অর্থের প্রবাহে স্থায়িত্ব আনা হলে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এমন এক কঠিন সময় পার করছে, যেখানে আস্থা, স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি সবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বৃহত্তর ঝুঁকি হলো আস্থার অভাব এবং আর্থিক খাতে নগদের অভাব। লক্ষ্যযুক্ত অর্থ মুদ্রণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের সমন্বিত কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও অর্থনৈতিক অবনতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে পারে। এই পন্থা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সহায়ক হবে।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
এইচআর/জেআইএম/ফারুক