দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় সিলেটে গড়ে তোলা হয়েছিল ছয়টি মৎস্য অভয়াশ্রম। এসব অভয়াশ্রমে মৎস্য নিধনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মাগুর, শিং, শোল, বোয়াল, ট্যাংরা, বাইম, রিটা ও পাবদাসহ দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ রক্ষার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দেশীয় বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ রক্ষা তো দূরের কথা, অভয়াশ্রমই রক্ষা করতে পারছে না মৎস্য অধিদপ্তর।
Advertisement
মাছের সঙ্গে মৎস্য অভয়াশ্রমও এখন নিশ্চিহ্নের পথে। রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা, দখল-দূষণ ও পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে ছয়টির মধ্যে তিনটি অভয়াশ্রমের কার্যকারিতা এখন আর নেই। কাগজে-কলমে যে তিনটি অভয়াশ্রম রয়েছে, সেগুলোরও কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই। আবার কোনোটির রক্ষকই ভক্ষক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।
তিনটি অভয়াশ্রম হারিয়ে গেলেও নতুন করে আরও একটি বিলকে মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করেছে জেলা মৎস্য অফিস। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনোপ এর কার্যক্রম শুরু হয়নি বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ রায়গড় এলাকার বুলবুলির খাল, ওসমানীনগর উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নের আলীপুর এলাকার জাফারখাল, একই উপজেলার সাদিপুর এলাকার সাদি খাল, জকিগঞ্জ উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের জামুরাইল এলাকার কুলগাং নদী, গোয়াইনঘাট উপজেলার গোয়াইন নদীর একটি অংশ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পেদারগাঁও এলাকার পিয়াইন নদীর একটি অংশকে মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
Advertisement
ছয়টি অভয়াশ্রমের মধ্যে ওসমানীনগরের জাফারখাল, কোম্পানীগঞ্জের পিয়ান নদী ও গোয়াইনঘাটের গোয়াইন নদীর অভয়াশ্রমের কার্যকারিতা এখন আর নেই। জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের অভয়াশ্রমের তালিকা থেকেও এ তিনটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য তিনটি বিলুপ্ত হলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মৎস্য অধিদপ্তরের ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের দিগারাইল এলাকার বড়বিলের এক হেক্টর এলাকাকে (ভেলি বিল) নতুন করে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র আরও জানায়, এসব অভয়াশ্রমে ঢেলা, সরপুঁটি, বামুস, গুলশা, পাবদা, রানি, বাঘাইড়, বোয়াল, বাইম, চেলা, চাপিলা, গাগলা, পুটা, রিটাসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষার জন্য মৎস্য নিধন সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়। এমনকী স্থানীয় পর্যায়ে সুফলভোগীদের নিয়ে একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসবের তদারকি করেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসন। এছাড়া কেউ যাতে মাছ শিকার করতে না পারেন, সেজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করাও হয়। কিন্তু কাগজে-কলমে এসব নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে তার চিত্র পুরো উল্টো। কেবলমাত্র একটি সাইনবোর্ড সাঁটানো ছাড়া মৎস্য অভয়াশ্রম রক্ষায় আর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অভয়াশ্রম থেকে নির্বিচারে মাছ শিকার করছেন স্থানীয়রা। মাছ লুটের সঙ্গে অভয়াশ্রম রক্ষা কমিটিরও অনেক সদস্য জড়িত থাকার খবর পাওয়া গেছে।
শুধু তাই নয়, জকিগঞ্জ উপজেলার একমাত্র মৎস্য অভয়াশ্রম থেকে লুট করা সবচেয়ে বড় বোয়াল মাছ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার বাসায় পাঠানোরও খবর পাওয়া গেছে। অন্য অভয়াশ্রমগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। শুধুমাত্র একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে ও বাঁশের কয়েকটি খুঁটি গেঁথে দায়সারার অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
Advertisement
এ বিষয়ে জকিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে মৎস্য অভয়াশ্রম থেকে মাছু লুটের বিষয়ে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতবছর এ অভয়াশ্রম থেকে মাছ লুটের অভিযোগ পেয়েছি। এবার মাছ লুটের কোনো তথ্য আমার কাছে আসেনি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’
ওসমানীনগর উপজেলার মৎস্য অভয়াশ্রমের অবস্থাও প্রায় একই। কেবল একটি সাইনবোর্ড ছাড়া মৎস্য অভয়াশ্রমের কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই সেখানে। জাল ও বড়শি দিয়ে দিনে-রাতে প্রকাশ্যে মাছ ধরা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে সুফলভোগীদের নিয়ে কমিটির দায়িত্বশীলরা মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ওসমানীনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাসরূপা তাছলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার উপজেলায় দুটি মৎস্য অভয়াশ্রম ছিল। সবশেষ ২০১৯ সালে জাফারখাল অভয়াশ্রমের জন্য বরাদ্দ এসেছিল। এরপর আর কোনো বরাদ্দ আসেনি। দখল-দূষণের কারণে এটির আর কার্যকারিতা নেই।’
তিনি বলেন, ‘সাদিখাল অভয়াশ্রমে কেউ মাছ ধরে না। মাঝে মধ্যে বড়শি দিয়ে কেউ মাছ ধরে। তবে আমরা সরেজমিনে গেলে কাউকে পাই না।’
এ বিষয়ে সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সীমা রাণী বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘মৎস্য অভয়াশ্রম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে একটি কমিটি রয়েছে। স্থানীয় সুফলভোগীদের নিয়ে এ কমিটি করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনও এটি দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। একজন অফিসার পরিদর্শনে যেতে অনেক কষ্ট হয়। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে বরাদ্দ আসে তা দিয়ে খুব বেশি কাজ করা যায় না। প্রতিবছর সাইনবোর্ড ও বাঁশের খুটি গেঁথে নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। এরপরও যদি কেউ মাছ লুট করেন, তাহলে আমাদের কী করার আছে?’
আহমেদ জামিল/এসআর/এএসএম