ক্যাম্পাস

দেশে প্রথমবারের মতো ঘোড়ার শরীরে মিললো প্রাণঘাতী রোগের জীবাণু

ঘোড়ার একটি অতিপ্রাচীন ও মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ ‘গ্লান্ডার্স’। এই রোগ ঘোড়া থেকে মানুষে সহজে ছড়াতে পারে। বাংলাদেশে গ্লান্ডার্সের উপস্থিতি নির্ণয় এবং কোন কোন ফ্যাক্টর এ রোগের ঝুঁকি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে তা জানতে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন দুই গবেষক। গবেষণায় দেশের ঘোড়াগুলোর মধ্যে গ্লান্ডার্সের উপস্থিতি মিলেছে।

Advertisement

গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান। তার সঙ্গে আছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. কে. আনিসুর রহমান ও সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্নেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য।

মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন কনফারেন্স রুমে কর্নেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য তার পিএইচডি সেমিনারে ওই গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন।

গবেষণার আওতায় ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলায় পালিত ৭৫৩টি ঘোড়া থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব নমুনা বাকৃবির মেডিসিন বিভাগের ল্যাবরেটরি, জার্মানির ফ্রেডেরিখ লোফলর ইনস্টিটিউট এবং ভারতের ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অব ইকুয়াইনে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।

Advertisement

বাকৃবির অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান জানান, গ্লান্ডার্স রোগটি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নির্মূল হলেও এখনো মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এর উপস্থিতি বিদ্যমান। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে এ রোগের প্রকোপ রয়েছে। এসব দেশে ২০০৬ সাল থেকে রোগটির পুনরুত্থান ঘটে।

তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের প্রায় চার হাজার কিলোমিটারের অধিক স্থলসীমান্ত রয়েছে, যার অনেক স্থান সুরক্ষিত নয়। ফলে এ সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রায়ই অনুমোদন ছাড়া ঘোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে। ফলে প্রাণীর সঙ্গে ওই প্রাণীর রোগও দেশে চলে আসে। তাই আমাদের দেশের ঘোড়াগুলোর মধ্যে গ্লান্ডার্সের উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক।

তবে বাংলাদেশে এ রোগের উপস্থিতি আছে কি না, সে বিষয়ে কোনো গবেষণাকর্ম পরিচালিত না হওয়ায় এ রোগের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি।

অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এটি শুধু প্রাণী স্বাস্থ্যই নয়, জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। গবেষণা মোতাবেক ৩.৪৫ শতাংশ ঘোড়ার মধ্যে এ রোগের জীবাণুর উপস্থিতি দেখা গেছে। গবেষণায় পুরুষ ঘোড়ার মধ্যে গ্লান্ডার্সে আক্রান্তের হার বেশি। গবেষণা অনুযায়ী যেসব ঘোড়ার বয়স ৬ বছরের বেশি এবং গাড়ি টানায় ব্যবহৃত হয়, সেসব ঘোড়া এ রোগে বেশি আক্রান্ত।

Advertisement

বাকৃবি থেকে পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর থেকে সংগৃহীত নমুনায় গ্লান্ডার্সের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত ফলাফলে আরও দেখা গেছে, এ রোগে আক্রান্ত ঘোড়ার রোগ সম্পর্কিত লক্ষণের উপস্থিতি ন্যূনতম অর্থাৎ রোগটির জীবাণু ঘোড়াগুলোতে সুপ্ত অবস্থায় ছিল।

গবেষক কর্নেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য জানান, গবেষণার আওতায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ঘোড়া পালনে সরাসরি জড়িত বেশিরভাগ মানুষের এ রোগের বিষয়ে ধারণা নেই। বিশেষত স্বল্প শিক্ষিত ঘোড়া পালকদের বেশিরভাগই বিষয়টি জানেন না এবং সচেতন নন। এমনকি কোনো ছোঁয়াচে রোগ হলে যেসব স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হয়, সেসব বিষয় তারা অবগত নন।

এ রোগের জীবাণুর নাম ‘বুরখোলদেরিয়া ম্যালেই’ যা আমেরিকান রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্যাটাগরি ‘বি’ জীবাণু অস্ত্র হিসেবে তালিকাভুক্ত। এ রোগের জীবাণু যুদ্ধক্ষেত্রে জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার নজির আছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধ বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী ওই জীবাণু ব্যবহার করেছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ ও ঘোড়ার মৃত্যুর সম্ভাবনা ব্যাপক। কেননা এ রোগের চিকিৎসা এখন পর্যন্ত অপ্রতুল।

গবেষক কর্নেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য বলেন, এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি লাঘবে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করত ৪-৫ বছর মেয়াদি মনিটরিং এবং সার্ভিল্যান্স কর্মসূচি গ্রহণ জরুরি। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে বড় পরিসরে এ রোগ নিয়ে আরও গবেষণা পরিচালনা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে গ্লান্ডার্স প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

প্রসঙ্গত, গ্লান্ডার্স ঘোড়া থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীতে ছড়াতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত হলে জ্বর, চামড়ায় মারাত্মক ক্ষত, সন্ধিস্থল ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, রোগা হয়ে যাওয়া, কাশি, নাক দিয়ে ঘন শ্লেষ্মা নির্গত হওয়া, চামড়ায় অ্যালার্জির মতো নডিউল তৈরি ইত্যাদি দেখা যায়। তবে ঘোড়াতে এ রোগের জীবাণু দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকে বিধায় রোগের লক্ষণ প্রকাশ ছাড়া অবস্থান করে রোগ ছড়াতে পারে।

আসিফ ইকবাল/এসআর/এএসএম