জাতীয়

নির্দয়ভাবে সরকারের সমালোচনা চলছে, প্রত্যাশাটা আকাশচুম্বী

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে দেশে বহু জঞ্জাল তৈরি করে গেছে। সেটা আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রীরাও অনেক সময় বক্তব্য-বিবৃতিতে স্বীকার করে গেছেন। সেই জঞ্জাল এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও না পাওয়ার বঞ্চনায় এ সরকারের কাছে জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা।

Advertisement

সেই প্রত্যাশা দ্রুত পূরণ করতে না পারায় নির্দয়ভাবে সরকারের সমালোচনা করছে মানুষ। এটা একদিকে যেমন ভালো, অন্যদিকে তাদের পক্ষে কাজ করাটাকেও কঠিন করে তুলছে। সেজন্য সরকারকেও সতর্কতার সঙ্গে সঠিক পথে পা দেওয়ার এবং জনগণকেও প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর ধৈর্য ধরে সমালোচনার তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।

শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে ‘নাগরিক সমাজ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় এসব কথা বলেন তারা। এতে তিন শতাধিক এনজিওর শীর্ষ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইসিটি খাতসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অংশ নেন।

সভায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘একদিকে হিমালয়ের মতো আমাদের সমস্যা। অন্যদিকে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। সেই আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণে দৃশ্যমান কিছু না পেয়ে আমরা নির্দয়ভাবে সরকারের যে সমালোচনা করছি, তাতে সরকারের পক্ষে কাজ করাটা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘এ সরকারের সমর্থক যারা, বিরোধীপক্ষ যারা আছেন; তারা সবাই জঞ্জাল পরিষ্কার হোক—এটাতে একমত। তারা (আওয়ামী লীগ-বিএনপি) যেহেতু পারেননি, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু সেই কাজ গুরুত্ব দিয়ে এবং নিঃস্বার্থভাবে করার অঙ্গীকার করছে, সেজন্য সব পক্ষকে এ সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত হবে বলে মনে করি।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশ গঠন নিয়ে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সবাই এখন আশাবাদী। তবে তুমুল এ আন্দোলনের পর নিজেদের যারা জয়ী ভাবছেন, তাদের অনেকের এজেন্ডার মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তা-চেতনাটাও নেই। তাদের মধ্যে এখনো বিভিন্নভাবে বৈষম্য জিইয়ে রাখা বা প্রতিষ্ঠিত করার এজেন্ডা রয়েছে।’ তবে কোন দল বা গোষ্ঠীর এজেন্ডায় রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডা নেই, তা তিনি উল্লেখ করেননি।

সবপক্ষকে আত্ম-সমালোচনায় নজর দিতে হবে এবং এর বিকল্প কিছু নেই উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজকে এখানে সব সেক্টরের লোকজন আমরা বসেছি। পরামর্শমূলক কথা তুলে ধরছি। রাজনৈতিক সংস্কার, রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে কথা বলছি। মন খুলেই বলতে পারছি। এটাই স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের অর্জন।

‘আমার তো মনে পড়ে না আগে কখনও আমরা এমন একসঙ্গে বসেছি। এনজিও, সিএসও, রাজনৈতিক নেতা, আইসিটি শিল্পের প্রতিনিধি, প্রাইভেট সেক্টর এমন একসঙ্গে বসে আলাপ হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। এটা নিঃসন্দেহে নতুন এক বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

Advertisement

সভায় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, নাগরিক ও রাষ্ট্রের আচরণে ভারসাম্যের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে সীমিত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল নাগরিক সাম্য, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তির। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি বলেই ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতা বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের দাবি তুলেছেন, তারা রাজপথে রক্ত দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এখন রাষ্ট্র সংস্কারে কাজ করছে। দ্রুত সেই সংস্কার কাজ শেষ করতে সবার সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি সরকারকেও জনগণের প্রত্যাশা বোঝা এবং সেদিকে নজর রেখে কাজ করা উচিত।

রাজনৈতিক দলগুলোকে ঘর গোছানোর আহ্বান জানিয়ে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশীদ বলেন, দেশ পুনর্গঠনের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করতে হবে। আপনাদের পরামর্শে ও মতামত নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এখনই আমাদের দূরে সরাবেন না।

তিনি বলেন, একটা আন্দোলন শুরু হলো, যেখানে সবাই অংশ নিয়েছে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝিয়ে দেয় যে, বাবারা, তোমাদের অধীনে আমাদের নির্বাচন হবে না। তোমরা বসো। একটা অন্তর্বর্তী সরকার আসুক। তারা মাঠটা পরিষ্কার করে দিক, তারপর একটা নির্বাচন হবে। তোমরা ক্ষমতায় আসবে। এর মানে হলো অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় যায় না, তারা দায়িত্ব পায়। তবে আমরা জানি না এত কমপ্লেক্সের (জটিলতা) মধ্যে কতটুকু করতে পারবো। তবে একটা স্পেস (জায়গা) তৈরি করতে পারবো।

অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দেশের নাগরিক ও সুশীল সমাজকে আস্থা রাখার আহ্বান জানান পানিসম্পদ এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের যে দীর্ঘপথ, সেই রাস্তাটা মসৃণ হওয়ার বাস্তবিক কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না। সেজন্য বলবো, আমাদের ওপর একটু আস্থা রাখুন। এখনই অন্তর্বর্তী সরকার, সরকারের সফলতা নিয়ে উপসংহারে চলে আসার সময় হয়নি, কোনো কারণও ঘটেনি।’

রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা তথ্যের অবাধপ্রবাহ নিশ্চিত করছি। কেউ যখন কোনো আন্দোলন করছেন, দাবি তুলছেন; আমরা বলছি- আপনাদের মুখপাত্রকে পাঠান, আমরা বসবো; বলবো। আমাদের দরজা আলোচনার জন্য সবসময় খোলা। এটিই বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্র গঠনে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।’

পরামর্শ সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সিএসও অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক রাশেদা কে চৌধুরী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, চাকরিবিষয়ক ওয়েবসাইট বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ।

এএএইচ/এমএএইচ/জেআইএম