আমি নানা বাড়িতেই বড় হয়েছি। নিম্নমাধ্যমিক পর্যন্ত থেকেছি একটানা। সেখানে একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। নাম শেখ মো. আমিনুদ্দীন। তার বাড়ি সাতক্ষীরা। চাকরি করতেন মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার স্নানঘাটা ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায়। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে যোগ দিয়েছিলেন ‘বাংলা প্রভাষক’ হিসেবে। আমার নানা মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। তার বাবা মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ ১৯২৬ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালোবাসা এবং শিক্ষকের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে তাকে নিজের কাচারি ঘরে থাকতে দিয়েছিলেন।
Advertisement
আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের বাড়ি পাশের গ্রামেই। কিন্তু বাড়ি থাকতাম না। নানার সান্নিধ্যে বেশি আদর পেতাম। শুধু আমি একা নই, কাচারি ঘরে আমাদের অন্য আত্মীয়ও থাকতেন। সবার পড়াশোনার জন্যই একজন গৃহশিক্ষক দরকার ছিল। ফলে বাড়ির পড়া তার কাছেই তৈরি করতাম। বাংলা, ইংরেজি, গণিত পড়াতেন। হাতের লেখা চমৎকার ছিল। স্কুল থেকে এসে বিকেলে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতাম। তিনি সাতক্ষীরার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। তার কথা শুনে আমরা তৃপ্ত হতাম।
বর্ষাকালে তাকে নিয়ে নৌকা ভ্রমণে বের হতাম। বিলে থাকতো অথই পানি। তিনি বৈঠা ধরতে জানতেন না। আমিই নৌকা বাইতাম। একদিন শখ করে চাইলেন। কিন্তু পানিতে বৈঠা ফেলে টান দিতে গিয়ে ঝপাৎ করে পড়ে গেলেন বিলের মাঝে। সেদিন জানলাম, তিনি সাঁতারও জানতেন না। আমি লগি ফেলে তাকে এ যাত্রায় উদ্ধার করতে পেরেছিলাম।
একদিন আমাদের গ্রাম ও নানাদের গ্রামের সংযোগস্থলে গেলাম। আমরা ভাঙা একটি কাঠের পোলে (সেতু) উঠেছি পার হবো বলে। কিন্তু তিনি কাঠ ভেঙে পড়ে গেলেন খালের ভেতর। পানি-কাদায় নাস্তানাবুদ হয়ে যখন উঠে এলেন, হেসে ফেলেছিলাম। তিনিও হাসলেন। একটুও রাগ করলেন না। পরক্ষণে খারাপও লেগেছিল তার জন্য। সেদিন আর ঘুরতে যাওয়া হলো না। কাচারি ঘরে ফিরে গেলাম। এমনই হাসি-আনন্দে আমাদের সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল বন্ধুর মতো। আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। সুশিক্ষা দিতেন কৌশলে। ধীরে ধীরে তাকে যেন ভালোবেসে ফেলি।
Advertisement
তিনি বড় ধরনের ছুটিতে বাড়ি যেতেন। কারণ বাড়ি অনেক দূর। ঘন ঘন যেতে পারতেন না। তাছাড়া যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো ছিল না। এই বিভিন্ন ছুটিতে তিনি বাড়ি গেলে আমি চিঠি লিখতাম। তিনিও চিঠির উত্তর দিতেন। তিনি না থাকলে আমরাও কাচারি ঘরে থাকতাম না। ফলে একবার দীর্ঘ ছুটিতে কাচারি ঘরের ভেতর একটি শেয়াল মরে পড়েছিল। তিনি এসে নাকেমুখে গামছা বেঁধে তা পরিষ্কার করেছিলেন।
আরও পড়ুন
একজন সহজ-সরল মানুষ আজ মন প্রাণ খুলে হাসুনখুবই আন্তরিক ছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে ফেরার সময় কাঁঠাল নিয়ে আসতেন। এখনো তার বাড়ির ঠিকানা আমার মনে আছে। শেখ মো. আমিনুদ্দীন, প্রযত্নে আজিজ সাইকেল স্টোর, ডাকঘর পাটকেল ঘাটা বাজার, থানা তালা, জেলা সাতক্ষীরা। তখন তার কোনো ফোন নম্বর ছিল না। তার বাড়িতেও কখনো যাওয়া হয়নি।
নিম্নমাধ্যমিক পাস করে নানাবাড়ি ছেড়ে চলে যাই। স্যারও একসময় চাকরি নিয়ে চলে যান কালকিনি উপজেলা সদরে। তখন উপজেলায় গেলে তার সঙ্গে দেখা হতো। জড়িয়ে ধরতেন পরম মমতায়। সেই ছোট্টবেলার মতো। বাড়ির সবার খোঁজ নিতেন। নানাবাড়ির সবাই তাকে ভালোবাসতেন। তিনিও সবার নাম ধরে ধরে খোঁজ নিতেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গেও মিশে গিয়েছিলেন অনায়াসে। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি এখনো সবার হৃদয়ে স্থান করে আছেন।
Advertisement
অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে তিনি বিয়ে করেছিলেন। সন্তানের বাবা হয়েছেন। তার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আমিও আমার পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিশ বছর আগে একবার উপজেলা সদরে হয়তো শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। তারপর উপজেলা সদর ছেড়েও হয়তো চলে গিয়েছেন। আর খোঁজ পাইনি। তাই শেষবার বলছি এ কারণে যে, আর কখনো দেখা হবে কি না জানি না। আমার এই লেখা তার চোখে পড়বে কি না, তা-ও জানি না। তবে তিনি থাকবেন আমার হৃদয়ে। আমাদের হৃদয়ে। স্মৃতিতে থাকবেন অম্লান হয়ে। থাকবেন ভালোবাসার বন্ধনে, হৃদয়ের আসনে।
হয়তো তাকে চিঠি লিখতে লিখতেই একদিন আমি লেখক হয়ে উঠেছি। বাজারে আমার চৌদ্দটি বই পাওয়া যাচ্ছে। তার ব্যক্তিত্ব-আদর্শ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। তার কারণেই পাল্টে গিয়েছিল আমার চিন্তাধারা। তার জন্যই সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য পাঠে আগ্রহী হয়েছিলাম। বইপড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। জীবনের প্রথম হাতে নিয়েছিলাম ‘বিষবৃক্ষ’। এখনো তাকে অনুভব করি। আমাদের সম্পর্কের স্নিগ্ধতা এখনো বিরাজ করে অন্তরের অন্তঃস্থলে। এখনো তাকে খুঁজি। কিন্তু আমাদের দেখা হয় না আর।
এসইউ/এমএস