মধ্যযুগে কবিতার আদি মাতা ছড়ার উৎপত্তি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখনো ছড়ার বিকাশ ও বিবর্তন সমভাবে বহমান। আধুনিক বাংলা ছড়া পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে সাহিত্য জগৎ আলোকিত করছে। ছড়ার এই অগ্রযাত্রায় নিজেকে যুক্ত করে নেওয়া তরুণ এক ছড়ার কবির নাম আবিদ আজম। বিচিত্র রকমের ছড়ার বিষয় তার স্বভাবের অন্তর্গত। আবিদ অতিপরিচিতি-প্রিয়ভাজন হওয়ায় তার সাহিত্য মর্মে গ্রহণে আমি সক্ষম হয়েছি। আর যুক্তিযুক্ত কারণে তার ছড়ার স্বাদ আস্বাদনও আমার জন্য সম্ভবপর হয়েছে। আমি তার ছড়া-কবিতা ইত্যাদি রচনা পছন্দ করার কারণে শুরু থেকেই প্রশ্রয়ই শুধু নয়, উৎসাহ দিয়ে আসছি।
Advertisement
কবি আবিদ আজম বয়সে তরুণ হলেও তার ভেতর উদয়কালের রোদের উষ্ণতা, মিল আর বহমানতার মাধুর্য থির থির করে কাঁপছে। পড়তে আনন্দ লাগলেই আমরা বিষয়টা ধরতে হাতড়ে বেড়াই। সঙ্গত কারণেই আমি আবিদ রচিত ছড়াগুলোর ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েছি। বাংলা ছড়ার সমকালীন স্টাইল তার ছড়ার ভেতর দেখতে পেয়ে আমি উৎফুল্ল, আনন্দিত এবং একই সঙ্গে পুলকে শিহরিত হয়েছি। শিল্প-সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় নিবেদিতপ্রাণ এই তরুণের ছড়ার ছন্দ-তৃষ্ণা আর শব্দ চয়নের ব্যাকুলতা দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। ফলে, এই লেখকের কবিত্ব শক্তিতে আস্থাবান হতে আমার মতো যৎসামান্য একজন কবির অসুবিধা হয়নি।
আবিদ আজমের ছড়া-কবিতা আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। এখন দেখি ছড়া ছাড়া দেশ চলে না। ছড়া এ যুগের মরা মানুষকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দারুণ সব ছড়া রচনার ব্যাপারে আবিদ আজম বরাবরই প্রতিভার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তাই ক্রমাগত আমাদের কাব্যাঙ্গণে তার নামটি অনিবার্য হয়ে উঠছে। এক দশকের অধিক সময় সাহিত্যচর্চার ভেতর আবিদের প্রকাশিত চারটি বইয়ের ভেতর দুটি ছড়ার বই প্রকাশিত হয়েছে। সংখ্যার দিক থেকে তার ছড়া-কাব্য অতি অল্প সংখ্যক হলেও নিজের রচনাকে শিল্প করে তুলতে বরাবরই হুঁশিয়ার আবিদ। মুখে ছড়া বললেও এসব ছড়া বাংলা কবিতারই সগোত্র। ছন্দে-মিলে-তালে-মাত্রা, উপমা-উৎপ্রেক্ষায় এর মধ্যে দারুণ গতির সঞ্চার করেছে। আপন বেগে বয়ে চলেছে ছড়ার ছন্দ, ছন্দের গন্ধ মৃদু মন্দ বায়ে। ছড়ার অগ্রগতির জন্য বাক্যের তীক্ষ্মতা মিলের ঝংকার কান পেতে গ্রহণ করতে হয়। আবিদ আজমের ছড়ায় এই গুণ বর্তেছে।
আমি মনে করি প্রকৃত কবি হৃদয় আবিদের রয়েছে। তবে, সব কাজই চর্চায় সফল হয়। তেমনই ছড়া সাহিত্যের স্রষ্টাদেরও আমি পরিশ্রমের মাধ্যমে পরাক্রম প্রকাশের অনুরোধ জানাই। বাংলা ভাষায় সব সময় নতুন শব্দ, ধ্যান-ধারণা, মিল ও ছন্দের যেখানে অনুসরণ করা হয়েছে; সেখানেই ঝলমলিয়ে উঠেছে পাঠকের আনন্দ। আবিদের ছড়া শুনতে শুনতে আমি বিস্ময়ে-আনন্দে শিহরিত হয়েছি। একজন তরুণ কবির এমন সুফল আনয়নকারী রচনা পাঠকের মধ্যেও সমাদৃত হতে চলেছে বলে আমার ধারণা।
Advertisement
আমি আবিদের ছন্দ সিদ্ধির প্রশংসা করি। তার ছড়া নানান গুণে গুণান্বিত। আর সাহিত্যে স্বাতন্ত্র একটা অবস্থান তৈরিতে তার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। আমি এ তরুণ কবির অব্যাহত রচনা শক্তি কামনা করি। লিখতে পারলে আর চর্চায় লেগে থাকলে আবিদ অচিরকালের মধ্যেই আমাদের সাহিত্যে নিজের নামটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। ছড়া একধরনের কবিতাই। আমি চাই আনন্দ আর ভালোবাসার ভেতর আবিদ অবস্থান করে কাব্য-কথার বিকাশে মগ্ন থাকুক। আমি তার কবিতার সাফল্যে এবং ছন্দের আনন্দে বরাবরই আন্দোলিত হয়েছি। হয়েছি কৌতূহলী। অচিরকালের মধ্যেই সে ছড়াখ্যাতি অর্জন করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। এর জন্য চর্চা-সাধনা দরকার। শব্দের অনুভূতি আরো তীক্ষ্ম হওয়া দরকার। কানে মিলটা একটু বুঝতে হবে তো! সেটা বোঝার জন্য একটু উচ্চকণ্ঠ হওয়া প্রয়োজন। আবিদ আজমের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ছড়ার কারিগরি শিখতে হলে সবাইকে সরিয়ে ছড়াকে ধরিয়ে দিতে হবে। ছড়া একবার ধরা পড়ে গেলে সে নিজেকেই ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করতে থাকে। সবাইকে বলে ‘এই তো চোর ধরা পড়েছে’।
জীবন-জগতের নানান বিষয় নিয়ে মানুষের আবেগ-অনভূতি আর চেতনকে নাড়া দেওয়ার এক জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে আমার এ তরুণ বন্ধুর কলমে। আর, ভাষায় ও মিলে এই লেখকের স্বাতন্ত্র্য মহিমা অনুভব করা যায়। আবিদের অগ্রযাত্রা সহজ হবে বলে আস্থা রাখি। লিখতে হলে শিখতে হবে, দিগ্বিদিক ছুটতে হবে। তবেই পরিশ্রমের মূল্য দু’হাত ভরে গ্রহণ করা যাবে। এই ভরসা আমার রয়েছে। দারুণ একটা ব্যাপার হলো আবিদ পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করেছে, এটাও আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিশ্রম করতে হবে। কারণ পৃথিবীটা দাঁড়িয়ে নেই, ঘুরছে।
আরও পড়ুন
ছাত্র আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে যাদের গীতি-কবিতা সেলিম আল দীন ও কবিতা বিকেলের কহন কথাআবিদ ইতোমধ্যে আমাদের সাহিত্যে ছড়া-কবিতা, গল্পসহ নানাবিধ রচনায় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। আধুনিক কবিতার স্থান দখল করে নিচ্ছে ছড়া-পদ্য। এটা খুব একটা সুখবর না হলেও দুঃসংবাদ নয়। বোঝা যাচ্ছে, সাহিত্যে দিন বদলের সময় এসে গেছে। দেখতে হবে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। চলছি বললেই তো আর চলবে না। বলতে হবে ‘আমি চলে যাচ্ছি’। দলে যাচ্ছি, তার সঙ্গে বলে যাচ্ছি ভবিষ্যতের বাণী। আবার ছড়া সাহিত্য বাংলা কবিতার দিকে ফিরে আসবে বলে আস্থা রাখি। এটা যতই চমকপ্রদ হোক না কেন-এটি সত্য সংবাদ। তবে, এখন যুদ্ধ ঘোষণা করবে কে? সেটার জন্য অপেক্ষা। সত্য হলো, এই পথ পাড়ি দিতে গেলে কার মুখ প্রথম দেখতে পাবো—কোন কবির মুখ কী? কিংবা কোন গদ্য লেখকের অট্টহাসি! যেন লোকটা হাসতে হাসতে শিখেছিল কতদিন আগে, তা সে ভুলে গেছে। কেবল হাসছে। মানুষ তাকে পাগল বলছে না। কারণ হাস্যরস তাকে পাগলামি থেকে বাঁচিয়েছে। সে বলছে, ‘আমি আছি, আমি আছি সারাদেশের হৃদপিন্ডের কাছাকাছি’।আমি আছি, এই তো আমি আছি।
Advertisement
আমার ধারণা, মধ্যযুগে কয়েকজন শক্তিশালী কবির আবির্ভাবের ফলে ছড়া-কবিতা রচনার স্ফূর্তি পায়। শাসকদের রোশানলের আশঙ্কায় তারা নিজেদের নাম গোপন রাখতেন। ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিবো কি সে’? তারাই লিখেছেন এসব কালজয়ী ছড়া। আর ছড়া তো এখন কেবল ঘুম পাড়ানোই নয়, ঘুম তাড়ানোরও মোক্ষম হাতিয়ার। নানান সীমাবদ্ধতার পরও এসময়ের কবিরা সে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন বলেই ধারণা করি।
সাহিত্য-সাংবাদিকতা জগতের প্রিয়মুখ আবিদ আজম আমার তরুণ বান্ধব হিসেবে একযুগ ধরে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে। এর একটা মূল্য ধীরে ধীরে তার পাওনা হয়ে উঠেছে। এই মূল্য পরিশোধ করতে হবে সম্ভবতঃ আমাকেই। আমার একান্ত এই প্রিয়জনকে নিয়ে বলতে গেলে, অনেক বলতে ইচ্ছে করে। লিখতেও চাই তাকে মূল্যায়ন করে, সচেতনভাবে। কিন্তু বয়সের সীমাবদ্ধতা তো মানতেই হবে।
এ পর্যন্ত আবিদ আজম রচিত ছড়া দেখে তার ভবিষ্যৎ খানিকটা চেনা গেলেও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তবে, আবিদ আজমের মতো এই তরুণেরা আমাদের কালের ভালোবাসার সন্তান। তাদের চলার জন্য পথ ছেড়ে দিতে হবে, বলার জন্য মাইক। তারা পথে পথে নৃত্য করে বেড়াবে। বলবে-আমি আছি। আমি আছি সারাদেশের হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি। আমি আছি।
আমি আবিদের সুন্দর ভবিষ্যৎ ও কাব্যচর্চার ক্রমাগত পরিশ্রমের প্রশংসা করি। এই তরুণ কবির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে আপনা থেকেই, আমি লেখা পড়ে যখন আপ্লুত হই, তখন বয়সের সীমার কথা ভুলে যাই। বয়স দিয়ে সাহিত্য কিংবা বন্ধুত্বের বিচার হয় না। কবি আবিদ আজম তরুণ হলেও অরুণোদয়ের নরম রোদে উদ্ভাসিত হয়েছেন। আমি তার দীর্ঘ জীবন, লেখার শক্তি এবং সামাজিক সাহসের প্রশংসা করি। আবিদের সাফল্যের জন্য প্রার্থনায় আমি দু’হাত তুলে থাকলাম।
আবিদ আজমের ছড়া-কবিতা লেখার মেজাজটি সার্থকতায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এই তরুণ লিখতে আগোয়ান, কণ্ঠস্বর প্রধান এবং আত্মতৃপ্তিতে মহীয়ান। এসব সৃষ্টিশীল তরুণদের বক্তব্য হলো-‘লিখতে লিখতে বাঁচতে চাই, লিখেই লেখক সাজতে চাই’। সব মিলিয়ে এখনকার লেখকদের এই আয়োজনকে বলা যায় ‘যজ্ঞ’। এই যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দেবে এদেশের তরুণেরাই। জয় বাংলাদেশ। জয়-জন্মভূমি স্বর্গদপী গড়িয়সী। আবিদ আজমের জয় হোক।
(লেখাটি ২০১৪ সালে রচিত)
এসইউ/এমএস