সবচেয়ে সহজ মনে হয় উপন্যাস পড়া। আবার কঠিনও মনে হয়। একটি প্রেমের উপন্যাস পাঠককে সহজেই মোহিত করে। আবার বেদনায় আপ্লুত করে মুহূর্তেই। কখনো কখনো বিদ্রোহ ডেকে উত্তাল করে তোলে। ফলে সহজ ও কঠিনের এই বাস্তবতা মেনেই উপন্যাসটি পড়তে হয়। কেননা পানির মতো সহজ হলেও গভীরে তার কঠিনের স্রোত বয়ে যায়।
Advertisement
তরুণ কবি ও কথাশিল্পী শফিক রিয়ানের ‘আজ রাতে চাঁদ উঠবে না’ একটি সমকালীন প্রেমের উপন্যাস। এটি তার প্রথম উপন্যাস। প্রথম লেখা উপন্যাস বলেই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। বয়সে তরুণ এই লেখক পরিণত মেজাজের পরিচয় দিয়েছেন। তাই তো বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠাই সুখপাঠ্য। উপন্যাসের নামে কাগজ-কালির অপচয় করতে হয়নি তাকে।
উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে এভাবে, ‘পূর্ণিমার রাত, আলোর ঝর্ণা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে চারপাশে। আত্মভোলা এক জোছনায় হাজী মজিদের বাড়ি রূপ নিয়েছে জোছনার গুদাম ঘরে। গৃহত্যাগী জোছনার কথা মানুষ বলে থাকে হরহামেশাই।’ (পৃষ্ঠা-৯) এভাবেই শব্দের পর শব্দের বুননে কাহিনি এগিয়ে যায় তরতর বেগে।
কাহিনি মূলত মায়া নামের একটি মেয়েকে উপলক্ষ্য করে এগিয়ে গেছে। মায়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে এসেছে স্কুলমাস্টার বাবা আতাউর রহমান, মৃত মা, করিমন খালা, পিতৃতুল্য অভিভাবক হাজী মজিদ, মজিদের স্ত্রী আনোয়ারা, বান্ধবী তিথী, প্রেমিক সাহেদ, মোসাদ্দেক আলী এবং আলতাফ হোসেন প্রমুখ। তবে উপন্যাসের রহস্যময় একটি চরিত্র হচ্ছে ছাত্রী নিপীড়ক ও ধর্ষক রতন। যিনি একজন কলেজ মাস্টার।
Advertisement
উপন্যাসে মায়ার মুখ নিঃসৃত ভাষা প্রেমময়। তবে তার জীবনের ক্ষতগুলো গোপন এবং উচ্চারণের অযোগ্য। তার বিদ্রোহ ও বিপ্লব দীপ্তিময়। মায়ার প্রেম দেখে পাঠকের হৃদয়ে প্রেম জাগে, গোপন ব্যথার কান্না দেখে পাঠকের চোখে জল আসে। তার প্রতিবাদ আমাদের সংঘবদ্ধ করে। প্রতি পৃষ্ঠায় পাঠক তার সফলতা কামনায় বাধ্য হলেও জীবনদানে ব্যথিত হন। মায়ার ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা ব্যাপকভাবে নাড়া দেয় পাঠকের অন্তরে।
কাহিনি নির্মাণ ছাড়াও শফিক রিয়ানের রচনাশৈলী আমাকে আশান্বিত করেছে। তার বাচনভঙ্গি আকৃষ্ট করেছে। বর্ণনায় একটি মোহময় পরিবেশ তৈরি করেন লেখক এভাবেই, ‘আজও পূর্ণিমা। অন্ধকারের ঝাঁপি খুলে সন্ধ্যা নেমেছে আজ। গোমরামুখী আকাশ দিনভর বৃষ্টি ঝরিয়েছে। রাত গভীর হতে হতে আকাশের সেই রূপ হয়েছে ঝলমল। পৃথবীর বুক ভরে গেছে চাঁদের আলোয়।’ (পৃষ্ঠা-১৮) এভাবেই উপমা আর রূপকের সাহায্যে দারুণ প্রতিবেশ সৃষ্টি করেন শফিক রিয়ান।
আরও পড়ুন
কম্বুরেখপদাবলি: দেহ আর হৃদয়ের রেখা বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা: লেখকের দায়বদ্ধতাউপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র চিত্রণে নিখুঁত শিল্পীর মতোই পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রধান চরিত্র মায়ার জন্য হৃদয় কোণে ব্যথারা বিদ্রোহ করে ওঠে। মায়ারা একটি নতুন পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানায়। বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। লেখকের ভাষায়, ‘সাহেদ আর মায়া বসে আছে বিশাল এক বটগাছের নিচে। বৃষ্টি পড়ছে অনেকক্ষণ ধরেই। কিন্তু বটবৃক্ষের আশ্রয়ে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিশাল ডালপালা ছড়ানো বটবৃক্ষ তাদের দিচ্ছে ছাতার নিশ্চয়তা। তারা ভিজছে, ক্রমশ। তবে চুপসে যাচ্ছে না।’ (পৃষ্ঠা-২২)
Advertisement
কাহিনির প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ধরা দিয়েছে নারী নির্যাতন, প্রেম, সামাজিক বৈষম্য ও মানবিক মূল্যবোধ। শফিক রিয়ান উপন্যাসে সমাজের নারীদের ওপর নির্যাতনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। মায়া ও সাহেদের প্রেমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন অকপটে। মধুপুরের মানুষের জীবনযাত্রা ও সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। বান্ধবীর জন্য বান্ধবীর সংহতি প্রকাশকেও মহিমান্বিত করেছেন।
উপন্যাসের সাহসী ও রূপবতী ‘মায়া’ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করেছেন। তার অধিকারের জন্য বিদ্রােহ করেছেন। সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একাই লড়াই করে গেছেন। বুদ্ধিমতী ও প্রতিবাদী বান্ধবী তিথীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে। উপন্যাসের মাধ্যমে সততা, সাহস, ন্যায় বিচার ও ভালোবাসা প্রভৃতি মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্বও তুলে ধরেছেন।
জীবনের বিনিমেয়ে একটি কাহিনি রচনা করে যায় মায়া। লেখকের ভাষায় জানতে পারি, ‘ঘাসের বুকে শুয়ে ছিল মায়া। চারপাশে রক্তের বন্যা বইছিল যেন। পাশেই বসে চিৎকার করে কাঁদছিল একটা ছেলে, একজন যুবক। পরবর্তীতে জানা যায়, তার নাম সাহেদ। যাকে পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে।’ (পৃষ্ঠা-৯৫) এভাবেই রহস্য রেখে যান লেখক। কিন্তু সাহেদের কী হয়েছিল আমরা আর জানতে পারিনি। তবে মধুপুরে আর কখনো চাঁদ ওঠেনি, সে কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন হাজী মজিদ।
উপন্যাসজুড়ে পাঠক কামনা করেছিল, রহস্যময় চরিত্র কলেজ মাস্টার রতন যেন জয়ী না হয়। একশ আটটি লাল পদ্ম হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সাহেদের প্রেম যেন পূর্ণতা পায়। কিন্তু উপন্যাসের পরিণতি সেদিকে যায়নি। যে কারণে তার উপন্যাসটি পাঠকের মনে স্থায়ীভাবে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায়, শফিক রিয়ান সমকালীন বাংলা সাহিত্যে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন। তাই আমি বইটির বহুল প্রচার ও পাঠ কামনা করছি।
বই: আজ রাতে চাঁদ উঠবে নালেখক: শফিক রিয়ানপ্রকাশনী: ঘাসফুলপ্রচ্ছদ: শামীম আরেফীনপ্রকাশকাল: বইমেলা ২০২১মূল্য: ২২৫ টাকা।
এসইউ/এএসএম