একুশে বইমেলা

অবসরকে অর্থবহ করে তুলবে বই

একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন, আপনি উনিশ শতকে আছেন। ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। এমনকি কোনো প্রযুক্তিপণ্যও নেই আপনার হাতে। ফলে হাতে আছে কেবল অফুরন্ত সময়। কিন্তু ঘুমিয়ে বা তাস-লুডু খেলে আর কতটুকু সময় ব্যয় করা যায়। এমন অফুরন্ত সময়ের সদ্ব্যবহার করবেন কীভাবে? আমার মতে, এমন সময়ে বইয়ের রাজ্যে ডুব দিতে পারেন। শৈশবে আমার নানাকে দেখেছি অবসরে বই পড়তে। অবশ্য বইপড়াও ছিল তার কাছে কাজের মতোই। ফলে তার কোনো অবসর ছিল না। শিক্ষকতা ও কৃষিকাজের মতোই বইপড়াকেও কাজ হিসেবেই নিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, যা পড়লে জ্ঞান অর্জিত হয়; সেটি শখের বশে কেন? বরং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। তার কথাটি যদি মূল্যবান মনে করি, তাহলে বইপড়াও কিন্তু মূল্যবান কাজেরই অংশ। আমরা কেবল পাঠ্যবই পড়াকেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে থাকি। কেননা এর মাধ্যমে আমাদের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে থাকে। তাতে কতটুকু জ্ঞান অর্জিত হলো, তা ধর্তব্য নয়।

Advertisement

বইপড়াকে যদি আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনেই করে থাকি, তাহলে আপনার অফুরন্ত সময়ের সঙ্গী হতে পারে শুধু বই। কেননা বইপড়ার তৃষ্ণা সহসা নিবাড়িত হয় না। তা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। নেশার মতো বাড়তেই থাকে। একবার শুধু সাহস করে একটি বই হাতে নিন। দেখবেন তারপর বই-ই আপনাকে বারবার প্ররোচিত করবে। করোনাকালে দীর্ঘ লকডাউনে অনেকের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠেছে। অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, বাসায় বসে বসে স্মার্টফোন ব্যবহার করেও যখন তাদের বিরক্তি এসে গেছে; তখন নিজের অজান্তেই বই হাতে তুলে নেন। সে ক্ষেত্রে অবশ্য লেখকের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা লেখাকেও চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় হতে হয়।

বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তির রুচি একটি বিরাট বিষয়। কারো গল্প ভালো লাগে। কারোবা উপন্যাস। কেউ আবার ইতিহাস বা গোয়েন্দা কাহিনি পড়তে পছন্দ করেন। ফলে প্রত্যেকে তার রুচি অনুযায়ী বই সংগ্রহ করে থাকেন। যে কারণে ব্যক্তির পছন্দের বই-ই তার ব্যক্তিগত পাঠাগারে মজুত থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে কোথাও বেড়াতে গিয়ে যদি আটকা পড়ে যান, সেক্ষেত্রে বই বাছাই করা একটু কঠিন। লেখকের নাম ধরেও বই পড়া যায়। কিংবা লেখক সম্পর্কে যদি কিঞ্চিৎ ধারণা থাকে, তাহলেও তার বই পড়ে দেখা যায়। আবার কোনো ধারণা ছাড়াই হুট করে পড়া শুরু করতে পারেন। যদি কিছুটা পড়ার পর চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। ছোটবেলায় আমার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিল। এক আত্মীয়ের বাসার পারবারিক পাঠাগার থেকে কৌতূহলবশত অপরিচিত লেখক ড্যানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুশো’ পড়া শুরু করেছিলাম। বাংলা অনুবাদটি এতটাই ঝরঝরে ছিল যে, কাহিনি আমাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে। এখানে কিন্তু অনুবাদকের জোরালো ভূমিকা ছিল অবশ্যই।

তবে কোথাও যাওয়ার আগে নিজের ব্যাগে দু-চারটি বই অবশ্যই নিতে পারেন। কারণ সব বাঙালির বাসায় আপনি পাঠাগার না-ও পেতে পারেন। কারো কারো বাসায় বীজগণিত আর পাটিগণিত পাবেন শুধু। কোনো কোনো এলাকায় হয়তো পাঠাগারের সন্ধান পেতে পারেন। না হলে নিজের সম্বলকেই অবলম্বন ভাবতে হবে। ফলে আপনার অবসরকে অর্থবহ করে তুলবে বই। এখন কথা হচ্ছে—বই কি শুধু আনন্দই দেয়? না জ্ঞানও দেয়? এটা আসলে নির্ভর করবে পাঠকের চাহিদার ওপরে। আপনি বইয়ের কাছে কী চান? আনন্দ নাকি জ্ঞান? আবার দুটোই চাইতে পারেন। তবে গল্প-উপন্যাস-কবিতা আপনাকে আনন্দ এবং জ্ঞান দুটোই দেবে। আবার কৌতুক বা রম্যকাহিনি পড়েও আপনি আনন্দ এবং জ্ঞান দুটোই পাবেন। এটি পুরোটাই নির্ভর করবে আপনার চাহিদার ওপর।

Advertisement

আরও পড়ুন

পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক কিছু বই ড. মাহবুবুল হকের যেসব বই পড়া জরুরি

ঘরের কথাই যদি বলি, আমার বাবা বাসায় বেড়াতে এলে বই পড়েই সময় কাটাতেন। বাড়িতেও সুযোগ পেলে বই পড়তেন। এমনকি যে কোনো লেখা হাতের কাছে পেলেই পড়তেন। আর অন্যদিকে আমার স্ত্রী এক হুমায়ূন আহমেদের বই ছাড়া অন্য কারো বই পড়েছেন বলে আমার জানা নেই। তবে কালেভদ্রে শরৎ ও মানিকের উপন্যাস পড়তে দেখেছি তাকে। তবে দীর্ঘদিন বুদ হয়ে থাকতে দেখেছি হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে। তার সহজ উত্তর, ‘তার (হুমায়ূন আহমেদ) লেখা আমাকে খুব টানে। কাহিনির শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায়।’ আমি বহুবার তাকে আহমদ ছফা, জহির রায়হান, শহীদুল জহির বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই হাতে দিয়ে দেখেছি, বেশিদূর যেতে পারেন না। তাই মজা করে তাকে বলি, নিম্নরুচির পাঠক। তার এই বিশেষ একজনের লেখায় আকৃষ্ট হওয়ার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। ফলে তার জন্য খুঁজে খুঁজে ওই একজনের বই নিয়ে আসতে হয়। এটিই হয়তো পাঠকরুচির রকমফের। তিনি হয়তো আনন্দ লাভের জন্যই বই পড়েন।

কারো কারো কাছে বইপড়াই আসল কাজ। তাদের মতে, পাঠকরুচি বিবেচনা করবেন প্রকাশকরা। তারা বিভিন্ন ধাচের বই প্রকাশ করে পাঠককে উদ্ধার করবেন। বিভিন্ন জনরার বই এ কারণেই প্রকাশিত হয়। লেখকরাও বিভিন্ন জনরার লেখা পাঠককে উপহার দেন। বিশাল এই পাঠকগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য সচেষ্ট সবাই। এভাবেই পাঠকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং বইপড়া আন্দোলন আলোর পথে এগিয়ে যায়। একদিন অবসরে বইপড়ার অভ্যাসই হয়তো তাকে নিয়মিত বই পড়তে আগ্রহী করে তুলবে। এই পাঠাভ্যাসই তাকে গাড়িতে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, বিমানে, স্টেশনে, পার্কের বেঞ্চে বসেও বই পড়তে উৎসাহিত করবে। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি বইপড়ার সময়টুকু ঠিকই বের করে নেবেন।

অবসর থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে এই অবসরই ভালো। শুধু নিজের অভ্যাসটাকেই একটু বদলে ফেলা দরকার। তথ্যপ্রযুক্তির এই অপার সম্ভাবনার সময়ে একটু সময়ের জন্য হলেও চোখ বন্ধ করে ভাবুন, সেই উনিশ শতকের কথা। শৈশবের কথা। আপনি চিঠি লিখছেন, বই পড়ছেন, জমিয়ে রাখা পুরোনো কাগজ পড়ছেন। জাস্ট একটু ভাবুন। শুধু হাতের স্মার্টফোনটা কিছু সময়ের জন্য একটু দূরে রাখুন। স্মার্ট টেলিভিশনটি কিছুক্ষণের জন্য অফ করে দিন। হাতে তুলে নিন একটি বই। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যান বইয়ের গহীনে। কেননা বই পড়ে কেউ দেউলিয়া হয় না। বই পড়ে কেউ দুর্নীতিবাজ হয় না। বই পড়ে কেউ ঘুসখোর হয় না। বই পড়ে কেউ অন্যায় করতে পারেন না। তাই আসুন বই পড়ি, দুর্নীতি ও অন্যায়মুক্ত নিজেকে গড়ি।

Advertisement

এসইউ/এমএস