নথুল্লাবাদ থেকে ছোট একটি হলুদ রঙের অটো নিলো রেখা। চলল মহাসড়ক ধরে। মিষ্টি একটা বাতাস এসে লাগল তার গায়ে। এ যেন সাত রাজার ধন। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে গরম পড়তে শুরু করেছে। বৈশাখ মাসে তো গ্রীষ্মকাল শুরু হয়েই গেল। আষাঢ় মাসে গরমের তীব্রতা আরও বেড়ে গেল। শ্রাবণ মাসেও প্রচণ্ড রকম গরম পড়েছে। আজ ভাদ্র মাসের আট তারিখ। শরৎকালটা আসার পরে গরম কিছুটা কমেছে। বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে একটু স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে। আকাশের রংটা গাঢ় হয়েছে। মেঘের রংটা সাদা হয়েছে। দু’একটা জায়গায় কালো রংটাও আছে।
Advertisement
খুব ভালো লাগছে রেখার। সরকারি দপ্তরগুলোর সামনে ক্রিসমাস, দেবদারু, থুজা, ঝাউ আর বিভিন্ন রকম বাহারি গাছ। দেখতে বেশ ভালো লাগছে। একটি দপ্তরের সীমানা প্রাচীর ঘিরে অনেকগুলো নারকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় যেন ওগুলো ফলের গাছ নয়; সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যই ওগুলো লাগানো হয়েছে। একটি কাঠবাদাম গাছও যে এত সুন্দর তা কি না দেখলে সবাই বুঝবে? সবাই তো জানে সৌন্দর্য মানেই ফুলের গাছ। সব ফুলে গন্ধ থাকে না। তবুও ফুল ফুলই। ফুলের সৌন্দর্য সহজেই চোখে পড়ে। পাতার সৌন্দর্য সবার চোখে পড়ে না। উঁচু পুলটা পার হওয়ার সময় দারুণ একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। আমলকি গাছে ছোট ছোট ফল ধরেছে। ওপর থেকে দেখলে সব গাছই সুন্দর লাগে। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া বা আমলকির পাতাগুলো এত সুন্দর লাগে যা বলে বোঝানো যায় না।
উনিশশ আটানব্বই সনে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত, আবার দুই ঘণ্টা থাকত না সেটাও মনে আছে তার। ওই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বেশি গরম। এখন তো বিদ্যুৎ থাকলেও গরম লাগে। প্রতি বছর গরমটা বাড়ছে। যে হারে গাছ কাটা হয় সে হারে লাগানো হয় না। নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে। আধুনিক গৃহস্থালি সামগ্রী পরিবেশটা গরম করে ফেলেছে। গরমের কষ্ট সহ্য করতে পারে না রেখা। বেশি গরম লাগলে চোখে সমস্যা হয়। চোখের সামনে কুয়াশার মতো দেখা যায়। গলাব্যথা হয়। শরীরের লবণ কমে যায়। মাঝে মাঝে গলাব্যথাটা মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়। তখন সর্দি, কাশি, জ্বর; বুকে, চোখে, নাকে আর মাথায় ব্যথা হয়। বেশি জ্বর হলে কান ভারী হয়ে যায়। শোনার শক্তি কমে যায়। মাথা নিচু করলে কানে ব্যথা লাগে।
রাস্তার দুপাশে সবুজের ছড়াছড়ি। দেবদারু গাছের নতুন পাতাগুলো সবুজ আর খয়েরির মাঝামাঝি। বাতাসে কাঁপছে। বিভিন্ন রকমের পাতাবাহার গাছ দেখা যাচ্ছে। চিকন, চ্যাপ্টা, লাল, সবুজ, হলুদ, এক রং, একটার বেশি রং, সবগুলো সুন্দর। লাল পাতার গাছে সবুজ কচি পাতা। সবুজ পাতার গাছে লাল কচি পাতা। পাতার রং ও সৌন্দর্যের এত বৈচিত্র্যের জন্যই এই গাছগুলোর নাম পাতাবাহার। ফুলের চেয়ে এ গাছের পাতাই সুন্দর। বকুল গাছে ফুল নেই তবুও সুন্দর লাগছে। নতুন পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে। সাইকাস গাছে স্ট্রোবিলাস নেই। গাছটাই সুন্দর। মেহেদি গাছের চিকন চিকন ডালগুলো খাড়া হয়ে আকাশের দিকে ছুটেছে। ফুলগুলো খুব সুন্দর। ছোট ছোট চালতা ঝুলে আছে গাছে। প্রকৃতি এত সুন্দর! গ্রামে যেতে পারলে আরও ভালো লাগত। এখনো কয়েকজন মুরুব্বি বেঁচে আছেন। কে কখন চলে যান বলা যায় না। খুব মনে পড়ে সবার কথা।
Advertisement
চোখের পানি মুছল রেখা। আজ আর মন খারাপ করা নয়। আজ শুধু ভালো থাকার দিন। অনেক দিন পরে একটু বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। এটাকে ভালো করে গায়ে মাখতে হবে। রাস্তার দুপাশটা দেখতে হবে। জীবন তো একটাই। জীবনটাকে ভালোবেসে ভালো রাখার দায়িত্ব ব্যক্তির নিজের। মহাসড়কের দুপাশে নিচু জমি। সে জমির একটা জায়গা ভরাট করার জন্য বালু আনা হয়েছে নদীর পাড় থেকে। আর তাই কাশবন হয়ে গেছে জায়গাটা। অটোটা থামালো রেখা। বাতাসের স্পর্শে ঝিরঝির একটা শব্দ করছে বনটা। পাশে একটা গভীর জলাশয়ও আছে। অনেক মাছ সেটাতে। একটু পর পর লাফ দিচ্ছে। কঞ্চিসহ বাঁশ পোঁতা আছে। কেউ চুরি করার সাহস পাবে না। রাস্তার পাশে কতগুলো খেজুর গাছ। কাণ্ড মাটি থেকে ওপরে ওঠেনি। সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তরতাজা পাতা। পাতার মাথায় কাঁটা আছে অথচ দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। শিরীষ গাছগুলো খেজুর গাছগুলোর আত্মীয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জলাশয়ের ওপরে নুয়ে আছে ওরা। অপরূপ সৌন্দর্য বিলিয়ে দিচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে। কাশফুল ফুটলে একদিন বসতে হবে এখানে। বসার জন্য কিছুটা খালি জায়গা আছে। অটোতে উঠে গেল রেখা। আজ এত ভালো লাগছে কেন? যেদিকে চোখ যায় শুধু সুন্দর আর সুন্দর। কবিরা বোধ হয় এই সৌন্দর্যকেই শোভা বলেন। এত সুন্দর বাতাস কোথায় ছিল এতদিন?
রাস্তার পাশে একটা বেল গাছে অনেকগুলো বেল ঝুলে আছে। চৈত্র মাসে মেহগনি গাছে ফুল ধরেছিল। তার ফল এখন বড় বড়। জারুলের ফলগুলো পরিপক্ব হয়ে গেছে। বৃক্ষজাতীয় গাছগুলো ফুল দিয়ে, ফল দিয়ে, ছায়া দিয়ে রাখে। ওদের দেওয়ার কোনো শেষ নেই। বিনিময়ে পায় না কিছুই। মানুষ এত কিছু খায় গাছ থেকে, সেই গাছ কেটেই জায়গা বানায়। কী হবে এত জায়গা দিয়ে? পরিবেশই যদি ঠান্ডা না থাকে, বর্ষাকালে যদি বৃষ্টিই না হয় তা হলে এই পৃথিবী কি মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত থাকবে? আবার মন খারাপ হয় রেখার। অনেকগুলো বাতাস টেনে নেয় নিজের ভেতরে। ছেড়ে দিয়ে ভাবে, মানুষের মতো মানুষ হতে চাই না; গাছের মতো মানুষ হতে চাই। গাছ চলতে পারে না। মনের কথা বলতে পারে না। আমার সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই।
পৌঁছে গেছে রেখা। এখানে এসে তার প্রথম কাজ মন্দিরে যাওয়া। তার পরে দিঘির পাড়ে বসা। দিঘির চারপাশে বাঁধানো রাস্তা আছে। রাস্তার পাশে একটু পর পর বাঁধানো বেঞ্চি আছে। একটা খালি বেঞ্চিতে বসে পড়ল সে। শ্বেতদ্রোণ গাছে সাদা ধবধবে ফুল ফুটেছে। কাঁটানটে গাছ তো ফুলে ভর্তি। শিরীষ গাছে অল্প কিছু ফুল দেখা যাচ্ছে। পুকুরের পাড় থেকে রাস্তা অনেক ওপরে। বেঞ্চি আরও ওপরে। একটা আম গাছ পুকুরের পাড়ে। গাছে একটা টুনটুনি ডাকাডাকি করছে আর এক ডাল থেকে অন্য ডালে যাচ্ছে। সব ক’টা ডালেই গেল সে। হয়তো সঙ্গীকে খুঁজছে। না পেয়ে উড়ে গেল। আম গাছের তরতাজা পাতাগুলো যতটা সম্ভব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স্ক পাতাগুলো কিছুটা ছড়ানো। নাম না জানা অনেক গাছ মাটিতে গা দিয়ে বেড়ে চলেছে। সব গাছে ফুল। সাদা বা হালকা রঙের ফুলই বেশি। শরৎকাল বোধ হয় রঙিন ফুলের জন্য নয়। মেঘের রং সাদা, কাশফুল সাদা, চাঁদটাও থাকে অত্যন্ত সুন্দর ও উজ্জ্বল। সে চাঁদকে বলা হয় শরদিন্দু। হ্যাঁ, শরৎকাল আসলে শুভ্রকাল।
দিঘির পানিতে পানকৌড়ি আছে। একটু পর পর দেখা যাচ্ছে। একটা মাছরাঙা মাছ ধরার জন্য বসে আছে। এই পাড়ে বেশি বাতাস নেই। বাতাসের ওদিকে গিয়ে বসতে হবে। উঠে গেল রেখা। গাছপালায় ঢাকা নির্জন সরু পথ ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে চলল সে। তার একপাশে বিশাল দিঘি, একপাশে গাছগাছালি। দিঘির পাড়েও গাছপালা আছে। বিভিন্ন রকম পাখি ডাকছে। গাছের পাতাগুলো হালকা বাতাসে দুলছে। মন ভালো করে দেওয়া পরিবেশ চারদিকে। কেউ নেই সঙ্গে। ফেরার কোনো তাড়া নেই। কোনো কাজ নেই আজ। আজ শুধু প্রকৃতি দেখা আর মন্দিরে যাওয়া। তুমি যে-ই হও না কেন এ দুটো জায়গায় তোমাকে যেতেই হবে। না গেলে আত্মা পরিশুদ্ধ হবে না। আশুতোষের কথা মনে পড়ল। সে যখনই রাস্তায় হাঁটে; তখনই তার কথা মনে পড়ে। শেষ যেদিন আশুতোষকে সে দেখেছিল; সেদিন সে ছিল একটা লুঙ্গি আর বিস্কুট রঙের একটা শার্ট পরা। কণ্ঠে ছিল রবীন্দ্রসংগীত, ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না।’ রাস্তায় একা হাঁটছিল। রাস্তার একপাশে খাল, অন্য পাশে পাকা ধানের ক্ষেত। খালের অপর পাশের রাস্তায় হাঁটছিল রেখা। সে দৃশ্য এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এলো, ‘রেখা! রেখা!’
Advertisement
রেখার বুকের মধ্যে যেন ঝড় উঠল। মুহূর্তেই ঠিক করে নিলো নিজেকে। ফিরে তাকালো। যা অনুমান করেছিল তাই। আশুতোষ হাসছে। রেখা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘তুমি!’ হাত দুটো মেলে দিয়ে দৌড়ে এলো আশুতোষের কাছে। ওড়নাটা দুদিকে উড়ছিল। মনে হলো যেন বারো বছরের একটা কিশোরী। আশুতোষ হাত মেলে দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে এসেই হাত গুটিয়ে নিলো রেখা। কিছু বলল না মুখে। মনে মনে বলল, এতদিন পরে! আশুতোষও হাত গুটিয়ে নিলো। বলল, ‘কেমন আছিস, রেখা?’ রেখা হেসে বলল, ‘ভালো আছি, দাদা। তুমি কেমন আছ?’‘আমিও ভালো আছি। পৃথিবীতে এত কাজ, এত দায়িত্ব, বিবেকবান মানুষ কি ভালো না থেকে পারে?’‘জানি না।’‘তুইও তো বললি ভালো আছিস, তা হলে জানিস না কেন?’‘আমি বিবেকবান বলেই যে ভালো আছি তা তো বলিনি।’‘চল, বসি।’‘বসব বলেই তো এসেছি।’‘একা?’‘এর যে কত আনন্দ তা তুমি বুঝবে না।’
আরও পড়ুন
চাঁদপুরের তিনটি লোকগল্প সায়নদীপার গল্প: কুহকএরা দুজন ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশী বন্ধু। এক স্কুলে পড়াশোনা করেছে। বয়সে আশুতোষ দু’বছরের বড়। রেখা ছিল হালকা-পাতলা। আশুতোষ ছিল মোটাসোটা। তাই সব সময় একটা মুরুব্বি ভাব বজায় রাখত। রেখাও ছোট বোনের মতো সবকিছু দাবি করত। দুজন একত্রে আসা-যাওয়া করত। একবার স্কুলে যাওয়ার পথে একটা শিংওয়ালা গরু দেখে ভয় পেয়েছিল রেখা। তার হাতে খোলা ছাতা ছিল। সে গরুটার দিকে নুইয়ে ধরল। গরুটা দৌড় দিলো। রশিতে টান পড়ল। রশিটা মাটি থেকে ওপরে উঠে গেল। রশিতে পা বাধল রেখার। পড়ে গেল সে। পায়ে ব্যথা পেল কিন্তু আশুতোষকে বলল না। তা হলে সে ফিরে যেতে বলবে। দুপুরের দিকে পা ভারী হয়ে গেল। প্রচণ্ড ব্যথা। আশুতোষ তাকে কোলে করে বাড়ি পৌঁছে দিলো। বড় ভাইয়ের কোলে ওঠার মজাটা সে আর একবার উপভোগ করেছিল। তখন সে ষষ্ঠ আর আশুতোষ সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। দুজনই খুব সুন্দর ছিল। আশুতোষ ছিল বেশি সুন্দর। রেখা প্রায়ই বলতো, ছেলেদের এত সুন্দর হওয়ার দরকার কী? হাসতো আশুতোষ। বলতো, তুই কি কম সুন্দর নাকি?
রেখা যখন নবম শ্রেণিতে উঠল তখন আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেল। অনেক লম্বা হয়ে গেল। আশুতোষ রেখাকে নিয়ে অন্যভাবে চিন্তা করতে শুরু করল। দু’একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে তার ভালো লাগার কথা বলেও ফেলল। গোপনে তারা আশুতোষের পরিবারকে জানিয়ে দিলো। রেখা গরিব ঘরের মেয়ে। তারা অনেক ধনী। দুই পরিবারের সম্পর্ক যতই ভালো হোক, এটা করা যাবে না। আশুতোষকে তারা ভারতে পাঠিয়ে দিলো। ওর নানার পরিবার ওখানে থাকে। ওখানে থেকেই পড়াশোনা করল। বিয়েটা পর্যন্ত ওখানে করেছে।
ভারতে যাওয়ার পরে আশুতোষের খুব খারাপ লাগত। রেখার কাছে সে বলেও যেতে পারেনি। পরিবারের লোকেরা তাকে কৌশলে সরিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল কারো কাছে বলা যাবে না। তার ধারণা ছিল রেখা তার ভালোবাসার কথা জানে না। কিন্তু ত্রিশ বছর পরে যখন সে জানতে পারল যে রেখা বিয়ে করেনি; তখন তার খুব ইচ্ছে করল দেশে আসতে। দেশে এসে শুনলো রেখা শহরে থাকে। সরকারি শিশুসদনে চাকরি করে। সে শহরে এলো। শিশুসদনে এসে শুনলো সে ছুটিতে আছে। মাঝে মাঝে সে ছুটি নিয়ে মন্দিরে যায়। ওখানে একটা দিঘি আছে। সেটাতে হাত-মুখ ধোয়, পা ভিজিয়ে বসে থাকে। গাছের ছায়ায় বসে পাখির ডাক শোনে।
রেখাকে দেখে আশুতোষের খুব ভালো লাগল। সে ভেবেছিল রেখাকে দেখবে হালকা রঙের একটা শাড়ি পরা, একশটা চুল পাকা, পানও ধরেছে হয়তো। কিন্তু না, দৃশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। গাঢ় নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ, একটা চুলও পাকেনি আর নিটোল অবয়ব। মনে হয় যেন তার বয়স আঠারো কিংবা বিশ। বাইশ বলা যায় না কোনোভাবেই। আশুতোষ মাথার অর্ধেক চুল হারিয়ে বয়স দশ বছর বাড়িয়ে ফেলেছে। সে আবার রেখাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছিস, ভাই?’‘খুব ভালো।’‘স্বামী নেই, সন্তান নেই...।’রেখা হাতটা বাড়িয়েছিল আশুতোষকে থামানোর জন্য। কিন্তু তার ঠোঁট স্পর্শ করার আগেই ফিরিয়ে নিলো। আশুতোষ একটু অবাকই হলো। বলল, ‘আমি কি খারাপ কিছু বলেছি? তোরা যাকে অলক্ষুণে বলিস তেমন কিছু বলে ফেললাম?’‘কারো কথায় কিছু আসে-যায় না। সবকিছু ঈশ্বরের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।’‘বিয়ে করলি না কেন?’‘এখনই তোমার প্রশ্নের জবাবটা দিলাম। সবার অদৃষ্ট একরকম নয়।’‘তা হলে ভালো থাকিস কীভাবে?’‘এতগুলো শিশুর মা হয়েছি, এর চেয়ে বেশি সুখ আর কোথায়?’
দুজনই চুপ করে রইলো। ছোটবেলার কথা মনে পড়লো আশুতোষের। একবার ওরা দুটো মেয়ে আর দুটো ছেলে দুই কক্ষের একটা ঘর বানিয়েছিল। ঘর বানানো শেষ হওয়ার আগেই কলাপাতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। সেখানে আর একটা পাতা দেওয়া হয়েছিল। আশুতোষ ছিল নেতা। তার নির্দেশেই ঘরের বেড়া, চাল, দরজা সবকিছু হয়েছিল। এরপরে সংসার শুরু করার পালা। কে কার কক্ষে যাবে? দুটো ছেলেই রেখার স্বামী হতে চাইল। তাতে অন্য মেয়েটা রাগ করে চলে গেল। খেলা ভেঙে গেল। তারপরে আর কোনো দিন খেলাটা খেলতে ইচ্ছে করেনি তার। কেউ তাকে বলারও সাহস পায়নি। বিয়ে সবার হয়েছে। রেখার হয়নি। জীবনে একবার খেলার ছলেও সে সংসার করতে পারেনি। পাখিগুলো হঠাৎ করে এমন কিচিরমিচির করে উঠল যে, দুজনই হেসে ফেলল। দিঘির দিকে তাকিয়ে ছিল আশুতোষ। মাটির সোঁদা গন্ধটা নাকে এসে বেশ লাগছে। পানিমরিচের ফুলগুলো দিঘির ওপরে ঝুলে পড়েছে। রেখা আশুতোষের চোখের দিকে দৃঢ়ভাবে তাকাল। আশুতোষ বলল, ‘কিছু বলবি?’‘তুমি ইন্ডিয়া গিয়ে বিমলদাকে খুব চিঠি লিখতে, না?’‘না। একটা চিঠি লিখেছিলাম। সেটা যে তুই পড়েছিস, তা আমি কিছুদিন আগে জেনেছি। তারপরেই দেশে আসার কথা চিন্তা করেছি। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করতো তোর বর কী করেন, ছেলেমেয়েরা কত বড় হয়েছে। একবারও মনে হয়নি যে ভালোবাসা এমনও হতে পারে।’‘আমি কাউকে কোনো দিন ভালোবাসিনি। আমাকেও কেউ কোনো দিন ভালোবাসেনি।’‘আমি বেসেছিলাম। বলতে পারিনি। বলার জন্যও তো একটা সময় দরকার। সেই সময়টা হওয়ার আগেই আমাকে সরিয়ে নিয়েছিল।’‘ভালোবাসা বলার বিষয় নয়; এটা আপনি প্রকাশ পায়। এই যে বলছো না? নিজেকে ছোট করছো শুধু; আর কিছু নয়।’‘ঠিক বলেছিস। আমি কাপুরুষ বলেই তো তোকে বোঝাতে পারিনি যে আমি তোকে ভালোবাসি।’‘ভালোবাসা একদিনের বা একটা সময়ের জন্য নয়। সেটা চিরদিনের। জোর করে তোমার কাছ থেকে তোমার টাকা-পয়সা বা জায়গা-জমি কেড়ে নেওয়া যায়; ভালোবাসা নয়।’আশুতোষের মনে হলো, রেখা তার গালে কষে একটা চড় মারল। ঠিকই তো বলেছে সে। যে কোনো স্থাবর সম্পদ বা জনসম্পদ কেড়ে নেওয়া যায় কিন্তু ভেতরকার কিছু বিষয়, যেমন- সততা, জ্ঞান এগুলো নেওয়া যায় না। এই মেয়ে এত কিছু বোঝে! এত গুছিয়ে বলতে পারে! একটু রাগ নেই, ঝামটা নেই, আস্তে-ধীরে সহজ করে কঠিন কথাগুলো বলে দিলো! আর কোনো কথা বলার সাহস হলো না তার। রেখাও কিছু বলল না।
সারাদিন কথা বলল ওরা। নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই অথচ অফুরন্ত কথা। চোখের পলকেই যেন বিকেল হয়ে গেল। ফিরতে হবে। দুজনই গম্ভীর হয়ে দাঁড়ালো। বাসস্ট্যান্ড গেল। টিকিট নিলো। খাওয়া-দাওয়া করলো। তারপরে শুরু হলো নীরস কথা। বাস ছাড়ার সময় হলে রেখা আশুতোষকে বিদায় দিয়ে শহরে চলে যাবে। রাস্তার শব্দের মধ্য দিয়ে বিদায়ী সময় কাটাচ্ছে ওরা। রাস্তার বিপরীত দিকে একটা মন্দির আছে। কথার মধ্যে আশুতোষ বার বার মন্দিরের ভেতরে তাকাচ্ছে।
সাড়ে ছয়টা বাজলো। আকাশের রং স্তরে স্তরে বিন্যস্ত হয়ে গেল। নীল রংটা হালকা হলো। সাদা রংটা লালচে হলো। স্তরগুলো প্রায় সমান্তরাল। মনে হয় যেন এই স্তরগুলো সুবিশাল আকাশের পাড়। গাছের সবুজ পাতাগুলো কালো মনে হলো। আম গাছের মগডালে যে রঙিন পাতা, সেটা ঠিকই বোঝা যাচ্ছিল। বাসে ওঠার সময় হয়ে গেল। এটাই শেষ বাস। এটায় উঠতেই হবে। রেখা বিদায় নিলো। আশুতোষ তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
খালি অটো না পেয়ে রেখা একটা লাইনের অটোতে উঠলো। এক ভদ্রলোক বসা ছিলেন। রেখা তার পাশে বসল। আরও দুজন যাত্রী হলে অটো ছাড়বে। আশুতোষ রেখার অটোটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার খুব খারাপ লাগতে শুরু করল। কে এই লোকটা? রেখার সাথে যাবে? ওর গায়ে একবারও ধাক্কা লাগবে না? চালক বাসে উঠে তার নিজের আসনে বসলো। আশুতোষ দাঁড়িয়ে রইলো। বাস ছাড়ার ত্রিশ সেকেন্ডও বাকি নেই। আশুতোষ রেখার কাছে গেল। তার হাত ধরে অটো থেকে নামালো। রেখা অবাক হয়ে গেল। সারাদিনে একবারও হাত ধরেনি; হঠাৎ কী হলো? রেখার হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা মন্দিরে ঢুকলো। সিঁদুর পরিয়ে দিলো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। সারাদিনে এই প্রথম রেখার চোখ থেকে অশ্রু গড়ালো। আশুতোষ তাকে জড়িয়ে ধরলো।
এসইউ/এমএস