এবারের বইমেলায় কথাসাহিত্যিক সাঈদ আজাদের ‘তৃতীয় রিপু’ বইটি প্রকাশিত হয়। হাতে নেওয়ার পর প্রচ্ছদটি নজর কাড়ে। এছাড়া নামের মধ্যেই কেমন যেন একটা ঘোর কাজ করে। মনে মনে ভাবি, এই রহস্য উদঘাটন করতে হলে বইটি অবশ্যই পাঠ করতে হবে। বইটিতে লেখক নানাবিধ রহস্যের জট খুলেছেন সাবলীল বুননে। জটিল বিষয়কে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। অপরাধ বিষয়ক যে কোনো রচনার ক্ষেত্রে লেখককে অবশ্যই অপরাধ বিষয়ে জানতে হয়। সমাধানও করতে হয় আইনি প্রক্রিয়ায়। লেখক সেরকম প্রয়াসই দেখিয়েছেন।
Advertisement
আমরা জানি, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের চরিত্র মূলত ষড়রিপুরই সংমিশ্রণ। মানুষ অপরাধ করে কোনো না কোনো রিপুর তাড়নায়। তা সে যে ধরনের অপরাধই হোক না কেন। ষড়রিপুর কোনটি কখন কোন মানুষের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠবে, তা বোধহয় ব্যক্তি নিজেও জানেন না। আবার হয়তো জানেন? কিন্তু বোঝার চেষ্টা করেন না। অথবা কোনো কোনো মানুষ ভেবে-চিন্তে ছক করে ঠান্ডা মাথায় নিজেই রিপুকে পথ দেখিয়ে গন্তব্যস্থলে নিয়ে যায়।
ফলে ‘তৃতীয় রিপু’ আপাত প্রতীয়মান সাদাসিধে ঘটনার আড়ালে ঘটে যাওয়া পরিকল্পিত একটি অপরাধের উপাখ্যান। ‘তৃতীয় রিপু’ মানুষের চরিত্রের কালো দিক উন্মোচিত হওয়ার আখ্যান। এতে আছে নানাবিধ রহস্যের সমাধান। যে কারণে বইটি প্রকাশের পর পরই পেয়ে গেছে পাঠকপ্রিয়তা। আমার জানামতে, লেখকের প্রথম থ্রিলার উপন্যাস ‘তৃতীয় রিপু’। প্রথম থ্রিলার হিসেবে তিনি এ যাত্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপেই উৎড়ে যেতে পেরেছেন বলে মনে হয়। ঘটনার ঘনঘটায় রহস্যের জাল ছিন্ন করতে পেরেছেন।
সাঈদ আজাদ তার উপন্যাসের প্রথমেই ঢাকা শহরের চিরাচরিত আবহ তুলে ধরেছেন। পরিবেশ-প্রতিবেশ অঙ্কন করেছেন সুনিপুণ হাতে। ধর্মীয় আবহকে উপজীব্য করে টেনে নিয়ে গেছেন গল্প। শহরের একটি ফ্ল্যাট থেকে মা-মেয়ের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে একে আত্মহত্যা মনে হলেও পরে একে একে রহস্য বের হতে থাকে। এমনকি উপন্যাসের শেষের যে টুইস্ট, তা সব পাঠকেরই ভালো লাগবে। থ্রিলারের সফলতা মূলত এখানেই।
Advertisement
কাহিনির শুরুতেই আমরা একটি ধর্মীয় আবহ লক্ষ্য করতে পারি। উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে এভাবে, ‘গলির মুখের মসজিদটাতে মাগরিবের আজান শুরু হতেই লম্বা মতো একজন মহিলা গলিতে ঢোকে। তার আপাদমস্তক কালো বোরখায় আবৃত। হাতে মোজা, পায়ে মোজা। মুখ ঢাকা নেকাবে। সেইসবও কালোই। কালো চোখের চশমাও। একনজর দেখেই বোঝা যায় মহিলা বেশ পরহেজগার।’ (পৃষ্ঠা-৭) তার এই বর্ণনায় শুরুতেই একটি রহস্য দানা বাঁধতে থাকে। সেই রহস্যই পরিণতিতে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
কাহিনি বর্ণনায়ও এক ধরনের জাদুকরী প্রভাব রয়েছে। পাঠককে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার প্রতিটি বাক্যে বিদ্যমান। তিনি যখন লেখেন, ‘সবুজ গাছপালার ফাঁকে ঐতিহ্য আর গাম্ভীর্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাদা রঙের দোতলা বাড়িটা। দোতলা হলেও জমিদার বাড়ি বলে কথা! মোটা আর উঁচু উঁচু থামের বাড়িটার এক এক তলা এখনকার দুতলার সমান। সবটা মিলিয়ে বাড়িটাকে বর্তমানের পাঁচতলা বাড়ির সমান উঁচুই মনে হয়। সেজন্যই অনেক দূর থেকেও চোখে পড়ে সেটাকে।’ (পৃষ্ঠা-১৩-১৪) এরই মধ্য দিয়ে তিনি পারিবারিক আভিজাত্যকেও রিপ্রেজেন্ট করেছেন। এই আভিজাত্যের আড়ালেই এক ধরনের নোংরা মানসিকতারও জন্ম হয়েছে।
আরও পড়ুন
আদর্শ হিন্দু হোটেল: শোষণ এবং শাসিতের মেলবন্ধন সুবোধ ঘোষের গল্পসমগ্র: বোধের বিস্তৃত আকাশবলে রাখা উচিত, সাঈদ আজাদের ভাষা কিন্তু সহজ এবং নির্মেদ। তার আছে সাবলীল গল্প বলার দক্ষতা। এ কথা অকপটেই স্বীকার করতে হবে। শুধু ভাষার বৈচিত্র্য আর কারুকার্যময়তাই নয়, তার লেখায় আছে একটি নিটোল গল্পও। শব্দের জাদুতে তিনি পাঠককে অতি সহজেই আপন করে নিতে জানেন। এই উপন্যাসেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তার চরিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন সময়োপযোগী করেই। উপন্যাসের নুশরাত, জারিন, লিপি, হাসান সাহেব, ইলিয়াস, আলী হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, তাহমিনা হোসেন তিতলি, সাইফুদ্দিন, তুর্য, ময়ূরী, ইন্সপেক্টর আমজাদ, শাকিলা, সিনথিয়া, নির্মল, আসাদ, মাহফুজ এবং বিপ্লবরা তাদের চরিত্রের যথার্থ উপযোগিতা স্পষ্ট করতে পেরেছেন।
Advertisement
উপন্যাসে উঠে এসেছে ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, দেশভাগ, আশালতা নীড় থেকে রেহেনা মঞ্জিল ও সমসাময়িক সংকট। অপরাধ প্রবণতাকে তিনি উস্কে না দিয়ে প্রশমনের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে প্রশাসনিক যাবতীয় টার্মগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রথম থ্রিলারেই পাঠককে চমকে দিতে পেরেছেন। নুশরাত, তিতলি, সুবর্ণা ও সাইফুদ্দিনের চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে এক এক করে। তুর্যর কথোপকথনে উঠে আসে, ‘নুশরাত আপনার তুলনায় সত্যিই অর্ডিনারি। তবে সে মা হতে পারেনি। সে সাইফুদ্দিন সাহেবকে সন্তান দিয়েছিল। যা আপনি দিতে পারেননি।’ (পৃ-১৪৩) ফলে পারিবারিক এই টানাপোড়েন একসময় জাতীয় ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়।
উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই রহস্যের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। একটি খুনের সঙ্গে অপর খুনের সংযোগ খোঁজার চেষ্টা করা হয়। পারিবারিক কলহও যে খুনের মতো জঘন্য কাজ করাতে পারে—তারই আভাস দেওয়া হয়। চারিদিকে রহস্যের জাল এমন ভাবে বিস্তার করা হয়েছে যে, পুরো বই না পড়লে কাহিনি বুঝে ওঠা কঠিন হবে। এর প্রতিটি চরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কোনো কোনো চরিত্রের উপস্থিতি ক্ষণিকের হলেও পুরো উপন্যাসজুড়ে বিরাজ করেছে। পাঠকের অন্তরে দাগ কেটে যায়।
রহস্যোপন্যাসের যেসব বেশিষ্ট্য থাকা দরকার, সবই সাঈদ আজাদের উপন্যাসে বিদ্যমান। এমনকি উপন্যাসের সমাপ্তি হয় আরও একটি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। উপন্যাসের শেষটা আড়াই বছর পর। সুইজারল্যান্ডের ছোট একটি গ্রামে। সাইফের মৃত্যু এবং মাহফুজের মুখোশ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে যবণিকাপাত হলেও ঘাসে লেগে থাকা রক্তের দাগ হয়তো চিরতরে মুছবে না। নতুন রহস্যের সন্ধানে পাঠককে নিয়ে যাবে। শেষদিকে বলা হয়েছে, ‘বাম হাতের উল্টো পিঠে কপালের রক্ত মুছে, কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে লাশটা কোথায় কবর দেওয়া যায় ভাবতে থাকে মাহফুজ।’ (পৃ-২১৪)
এতেই প্রতীয়মান হয় যে, এ উপন্যাসের রহস্য আসলে শেষ হয় না। এভাবেই একের পর এক রহস্য হাজির হতে থাকবে সামনে। লেখক সাঈদ আজাদ ভবিষ্যতে আরও রহস্যের পেছনে হাঁটবেন, এ কথা অনায়াসেই বলা যায়। একই সঙ্গে তিনি তার সমাধানও করবেন। আশা করি ‘তৃতীয় রিপু’ পাঠকের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে। তাই আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
বইয়ের নাম: তৃতীয় রিপুলেখক: সাঈদ আজাদপ্রকাশনী: উপকথামূল্য: ৪৪০ টাকাপ্রকাশকাল: বইমেলা ২০২৪।
এসইউ/এএসএম