সাহিত্য

সায়নদীপার গল্প: কুহক

শীতটা এখনো থাবা বসায়নি পুরোপুরি। তবে গাছের বয়স্ক পাতারা অবসর নিতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। রাতের বেলা বাড়ির বাইরে পা রাখলেই একটা হিমেল হাওয়ার স্রোত এসে শিরশিরানি ধরিয়ে দেয় শরীরে। তাই নিদেনপক্ষে গায়ে একটা পাতলা চাদর না চড়িয়ে বেরোতে নেই। তবে অঘোর তান্ত্রিক অন্য ধাতের মানুষ; শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোনোকিছুই তাকে কাবু করতে পারে না। আজ কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া, আকাশে চাঁদের চিহ্নমাত্র নেই। মেঘও করেছে বোধহয়। তারাগুলোও মুখ লুকিয়েছে এই রাতে। রোজকার মতো চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসেছেন অঘোর তান্ত্রিক। সারাগায়ে তার বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, কেউ আসছে এদিকে। ঝরা পাতাগুলো আগন্তুকের পায়ে পিষ্ট হতে হতে মড়মড় শব্দে আর্তনাদ করে চলেছে অনবরত। হঠাৎ করে একসময় সেই আর্তনাদ থেমে গেলে অঘোর তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন আগন্তুক তার সীমানায় প্রবেশ করেছে। এখানকার অস্বাভাবিক আবহাওয়ার সাথে যুঝতে গায়ের চাদরটা খুলে ফেলছে এই মুহূর্তে। যথারীতি মিনিটখানেকের ব্যবধানে আবার শুরু হলো শব্দ। চোখ খুললেন অঘোর তান্ত্রিক, এখন আগন্তুক তার সামনে দাঁড়িয়ে।একটা কাজ করতে হবে তোমায়।আগন্তুকের গলায় উত্তেজনা স্পষ্ট। তাকে একবার আপাদমস্তক মেপে নিলেন অঘোর তান্ত্রিক। তারপরই তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো ক্রুর হাসি। ঠিক তখনই একটা রাতপাখি কোথা থেকে যেন কর্কশ স্বরে ডেকে উঠলো।

Advertisement

১.কী ব্যাপার মোহন, কবিরাজ মশাই কী বললেন?এভাবে গ্রামের কবিরাজ মশাইকে দিয়ে হবে না কাকিমা। তার চেয়ে বরং কাকাকে শহরে নিয়ে যাওয়া হোক। সেখানে অনেক ভালো চিকিৎসা হবে।আমি তো একবার তোমাকে বলে দিয়েছি মোহন, তোমার কাকাকে এই বাড়ি থেকে কোথাও নিয়ে যাওয়া যাবে না।‘কিন্তু কেন কা…’ প্রশ্নটা করতে গিয়েও থমকে যায় মোহন। জমিদারগিন্নির এই দৃষ্টি দেখলেই কেন জানি বুকের অন্তঃস্থল অবধি কেঁপে ওঠে, ‘আ… আচ্ছা কাকিমা, কাকাকে না হয় নিয়ে যাওয়া হলো না। কিন্তু শহর থেকে ডাক্তার বাবুকে তো আনা যেতেই পারে। আমার এক বন্ধু শহরের এক বড় ডাক্তারের কাছে কাজ করে, তাকে বললে সে…’এসবে কোনো লাভ হবে না আমি জানি। শহরের ডাক্তারও কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।কিন্তু আমরা এভাবে তো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না কাকিমা। কিছু তো একটা করতেই হবে।হুমম। যা করার এবার আমি করবো, ওটাই শেষ উপায়।কী উপায় কাকিমা?কিছু না।

শেষ কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান জমিদারগিন্নি। তার চলে যাওয়ার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে মোহন। তখনই কবিরাজের দেওয়া ওষুধ নিয়ে ঘরে ঢোকেন মোহনের মা, বিভা দেবী।মা, কাকিমা এমন জেদ কেন করেছেন বলো তো। একবার শহরের ডাক্তারকে ডেকে দেখালে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?ক্ষতি আবার হবে না! এই বাড়ি থেকে ঠাকুরপোকে বের করলেই যদি ওর জাদুর প্রভাব কেটে যায়!জাদুর প্রভাব! মানে!কিছু না। মোহন তোকে না কতবার বলেছি এদের ঘরের ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামাবি না। আমরা এদের ঘরে আশ্রিত, আশ্রিতের মতোই থাক।এ তোমার কেমন কথা মা! কাকা তো শুধু আমাদের আশ্রয়দাতা নন, আত্মীয়ও। তার বিপদেই চিন্তা করবো না?না, করবি না। তোকে কেউ চিন্তা করতে বলেছে? বলেনি তো। তাহলে চিন্তা করছিস কেন?মা…!আমার এক কথা বাবা, যত যা-ই হয়ে যাক ছোট গিন্নির মতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবি না। উনি ঠিক বলুন কি ভুল বলুন সব সময় সায় দিয়ে যাবি।তুমি কথাটা আমাকে বারবার বলো কেন মা? তুমি কাকিমাকে এত ভয়ই পাও কেন?সে তুই বুঝবি না। শুধু আমি যা বললাম সেটাই কর। আর এটুকু জানবি যে, ছোট গিন্নি যদি চান তো ঠাকুরপো ঠিক প্রাণে বাঁচবেন। আর না চাইলে স্বয়ং ভগবানেরও সাধ্যি নেই তাকে বাঁচাবার।এসব কথা বলে তো তুমি আমাকে আরও কৌতূহলী করে দিচ্ছো। আমার বারবার মনে হয় যে, তুমি অনেক কিছু জানো। যা আমার থেকে গোপন রাখতে চাও।কে বলেছে আমি কিছু জানি। আমি কিছু জানি না। যা বললাম তাই করবি ব্যাস। বলেই ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে চান বিভা দেবী কিন্তু মোহন তার আঁচল টেনে ধরে,মা তুমি যদি আমাকে কারণটাই না বলো, তাহলে কাজটা করতে কি আমার ইচ্ছে করবে?তর্ক করিস না মোহন।তর্ক নয় মা। জানতে চাইছি যে, সে কী এমন কারণ; যার জন্য কাকিমাকে তুমি এত ভয় পাও?

মোহন লক্ষ্য করে প্রশ্নটা শোনামাত্রই তার মায়ের চোখেমুখে যেন এক আশ্চর্য পরিবর্তন ফুটে ওঠে। ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে আশপাশটা দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলেন, ‘এখানে নয় বাবা, ঘরে চল।’

Advertisement

২.একরাশ ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি তুলে দেয় নিবৃত্তি। ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্টতার মধ্যে তাকিয়ে দেখে ধুপ, ধুনা থেকে শুরু করে আরও বিচিত্র সব সামগ্রী ছড়ানো গোটা ঘরে। অঘোর তান্ত্রিকের কোলঘেঁষে একটা মড়ার খুলি উল্টো করে রাখা। তার মধ্যে তরল কী একটা জিনিস ভর্তি। সেসব পেরিয়ে সে দেখে হোমকুণ্ডের লেলিহান শিখায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠা অঘোর তান্ত্রিকের মুখটা, সিঁদুরে রাঙা কপাল চুঁইয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে তার নাকে। মাথার রগ দুটো দপদপ করছে উত্তেজনায়, চোখ দুটো রক্তবর্ণ। নিবৃত্তিকে দেখামাত্রই তিনি বলে ওঠেন, ‘এনেছিস?’হ্যাঁ। এই যে… বলে নিবৃত্তি আঁচলের তলা থেকে বের করে আনে একটা কচি ডাব। ডাবটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে একটা কাস্তে তুলে নেন অঘোর তান্ত্রিক। তারপর এক বিশেষ ভাবে কেটে ফেলেন ডাবের মাথাখানি।এই ডাবটার মতোই আমার শিকারকেও কেটে ফেলতে হবে তোমায়।হুম।তুমি পারবে তো?আজ যে বড় সন্দেহ করছিস আমার ক্ষমতার ওপর?এ সন্দেহ নয়, উত্তেজনা। ওসব তুমি বুঝবে না।হুম। কিন্তু তুই এই লোকটাকে বাঁচাতে চাইছিস কেন? এ না থাকলেই তো তোর সুবিধা।এত সহজ না সবকিছু। পথের আশেপাশে অনেক কাঁটা গজিয়ে রয়েছে। আগে সেগুলোকে উপড়ে ফেলতে হবে। তার জন্য লোকটার বেঁচে থাকা দরকার।পথের কাঁটা বলতে কার কথা বলছিস?বেশ কয়েকটা আছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মোহন। জমিদারের এক সম্পর্কিত ভাইপো। এই মুহূর্তে জমিদারের কিছু হয়ে গেলে প্রজারা সব ওর দিকে ঝুঁকে যাবে। খুব চালাক ছেলে ও। এতদিন আমার ন্যাওটা ছিল বেশ। কিন্তু আজকাল কেমন যেন অন্য দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। ওর মাকে অবশ্য আমি বিশ্বাস করি না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, সে আমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করে।সে কথা তো বুঝলাম। কিন্তু সে কে যার নাম তুই আমাকে দিয়েছিস?এরই মধ্যে ভুলে গেলে তাকে? আমার পথের সব থেকে বড় কাঁটা। ওরা ভেবেছিল, ওকে এই গ্রামেই এনে লুকিয়ে রাখবে আর আমি টেরও পাবো না। হা হা। নিবৃত্তিকে কি এতই বোকা ভেবেছে ওরা! যার জন্য জমিদার নিজের এই অবস্থা করলো, তার প্রাণেই বাঁচুক জমিদারের প্রাণ।আর সে যদি ডাকে সাড়া না দেয়?আবার চেষ্টা করবে। তাকে সাড়া দিতেই হবে। বলার পর এবার উত্তেজনায় চোয়াল শক্ত হয় নিবৃত্তির।তোর কাজ হয়ে গেলে আমাকে যা কথা দিয়েছিস, সেটা রাখবি তো?তোমার ওপর আমার কোনো সন্দেহ নেই, যখন-তখন তোমারও…নিবৃত্তি…কী?দরজার বাইরে কেউ আছে?সেকি!

ছুটে গিয়ে দরজা খোলে নিবৃত্তি। রাতের অন্ধকারে আশেপাশে কাউকে দেখতে পায় না। তবুও মনের সন্দেহ নির্মূল হয় না পুরোপুরি। দুজন পেয়াদাকে ডেকে নির্দেশ দেয়, আশেপাশে কেউ লুকিয়ে আছে কি না খুঁজে দেখতে।

৩.রাতের অন্ধকার ঠেলে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে মোহন। সে ভাবতে পারেনি, কাকার ঘরে আসা ওই তান্ত্রিকটা টের পেয়ে যাবে তার উপস্থিতি। ছুটতে ছুটতে এখন মোহন ভাবে, ওভাবে পালিয়ে না এসে কোনো একটা অজুহাত দিলেই তো পারতো বরং! কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর মাথা যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। আজ কাকার ঘরে গোপনে ওই তান্ত্রিককে ঢুকতে দেখেই চমকে উঠেছিল, তবে কি মায়ের সন্দেহই ঠিক! বাবা মারা যাওয়ার পর মোহনকে ওর এক মামা নিয়ে চলে যান নিজের কাছে। সেখানেই লেখাপড়া শেখে। এদিকে মা এসে জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেন। জমিদার মশাই ওদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। লেখাপড়া শেষ করে কাজের সন্ধানে বছর দুয়েক হলো মায়ের কাছে হাজির হয় মোহন। সেই অবধি ও এখানেই আছে। এখন জমিদার বাড়ির বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করে। এখানে আসার পর কাকিমার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছিল; ঠিক ততটাই অবাক হয়েছিল জমিদার মশাইয়ের নিস্পৃহতায়। সব ব্যাপারেই কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব। ঘোলাটে দুটো চোখ নিয়ে কী যেন আকাশ-পাতাল ভেবে যান সারাদিন। এতদিন এর কোনো কারণ খুঁজে পায়নি মোহন। সেদিন মায়ের কাছে কারণ হিসেবে যা শুনেছিল, তা বিশ্বাস করতে পারেনি সেই মুহূর্তে। ভেবেছিল, সব মায়ের কষ্ট কল্পনামাত্র। অথচ আজ নিজের কানে—কাকিমা মোহনকেও নিজের পথের কাঁটা ভাবেন। তার মানে মায়ের আশঙ্কা নেহাতই অমূলক নয়। আচ্ছা মোহনের তো জমিদার বাড়ির ওসব ধন সম্পদের ওপর কোনো লোভ নেই। কোনোদিনও চায়নি ওসব। শুধু চায় এই গ্রামে একটা স্কুল তৈরি করতে। গ্রামের শিশুগুলোকে যথোপযুক্ত শিক্ষা দিতে। কিন্তু এখন মোহন স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কাকিমার হাতে জমিদারির সমস্ত ক্ষমতা চলে গেলে ওর স্বপ্ন কোনোদিনই পূরণ হবে না। শুধু তা-ই নয়, গ্রামের ওপরও ভয়ংকর বিপদ নেমে আসবে।

আচমকাই ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়ায় মোহন। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর মাথায় খেলে যায় একটা কথা। কাকিমা কি শিকারের কথা বলছিল না! ওই তান্ত্রিককে কারুর একটা নাম বলেছেন উনি। কার নাম? কে হতে পারে সে? মোহনের সারাশরীর ঘামে ভিজে জবজবে। উত্তেজনায় বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ ওঠে। আকাশের দিকে একবার তাকায় মোহন। সরু একফালি যা চাঁদ উঠেছিল; সেটাও মেঘের আড়ালে পড়ে কেমন যেন ছায়া ছায়া দেখায়। যেন কোনো অমঙ্গলের ভয়ে মুখ লুকিয়েছে। গলাটা শুকিয়ে আসে মোহনের। কানের কাছে যেন জমিদারগিন্নির বলা কথাগুলো আবার বেজে ওঠে তীক্ষ্ণ স্বরে। ‘প্রাণের বদলে প্রাণ’। কাকাকে সুস্থ করতে ওরা কারুর একটা ভয়ংকর ক্ষতি করবে। হয়তোবা তার প্রাণটাই ছিনিয়ে নেবে! কিন্তু কার? তান্ত্রিকদের ক্ষমতা সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছে সে এতদিন। কিন্তু আজ অভিজ্ঞতাও হতে চলেছে বোধহয়। পাশে থাকা একটা গাছের গুঁড়ি ধরে ধপ করে নিচে বসে পড়ে মোহন। সে সব জেনেও কি কিছুই করতে পারবে না! কোনো এক অসহায়কে কাকিমার লালসার শিকার হতে দেবে! উফফ। সে কথা ভেবেই শিউরে ওঠে। দুহাত দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। তখনই হঠাৎ করে বাবার বলা একটা কথা মনে পড়ে যায়। বাবা বলতেন, ‘সব সমস্যার সমাধান সূত্র আমাদের মধ্যেই থাকে। শুধু সমস্যার সময় মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করা দরকার, উত্তেজিত হয়ে নয়।’ বাবার কথাটা মনে হতেই এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস পায় মোহন। একটা জোরে নিশ্বাস নেয়। তারপর সবকিছু আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করে। একটাই প্রশ্ন ওর মাথায় এসে ধাক্কা দেয় বারবার, কে হতে পারে কাকিমার সবচেয়ে বড় পথের কাঁটা! আর কী যেন বলছিলেন উনি, তাকে এই গ্রামেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে… এ রকম কিছু। হঠাৎ মোহনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। সেদিন মা বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলেছিল অনেক কিছু। তখন সেগুলোকে সেভাবে আমল দেওয়ার যোগ্য মনে করেনি মোহন। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে অনেক দরকারি কথা লুকিয়ে আছে তার মধ্যে। গাছতলা থেকে উঠে দাঁড়ায় মোহন। অনেকটা দম ভরে নেয় নিজের মধ্যে। সে যদিও ঠিক জানে না, যাকে খুঁজছে; সে কোন বাড়িতে থাকে। কিন্তু তাকে খুঁজে পেতেই হবে যে করে হোক। নয়তো তাকে বাঁচানো যাবে না। রাতের অন্ধকার ঠেলে আবার ছুটতে শুরু করে মোহন।

Advertisement

৪.গ্রামের ভেতর ঢুকে একটু দম নিয়েই আবার চরকির মতো পাক খেতে থাকে মোহন। ঠিক জানে না, কোন বাড়িটায় থাকে কাকিমার শিকার। কীভাবে খুঁজবে তাকে। কীভাবেইবা সাবধান করবে! অন্ধকারটা এতক্ষণে চোখে সয়ে গেছে অনেকখানি। আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে নজর বোলাতে বোলাতে হালকা পায়ে এগোতে থাকে মোহন। তখনই হঠাৎ কানে এসে লাগে এক নারীকণ্ঠ। সুমিষ্ট স্বরে কেউ যেন ডেকে ওঠে, ‘খোকন…’। চমকে ওঠে মোহন। এত রাতে কে কাকে ডাকে! আওয়াজের উৎস সন্ধান করে দ্রুত এগোতে এগোতেই কানে আরেকবার এসে লাগে সেই ডাক। মোহন অবশেষে এসে পৌঁছায় সেই বাড়ির কাছে। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে একটা নির্দিষ্ট জানালার সোজাসুজি। সেই ছায়ামূর্তি যেই হোক না কেন, কোনো মহিলা যে নয়, এ ব্যাপারে মোহন নিশ্চিত। ছায়ামূর্তি আরেকবার সেই নারীকণ্ঠ নকল করে ডাকে, ‘খোকন’। তৎক্ষণাৎ ঘরের ভেতর থেকে কে যেন সাড়া দিয়ে ওঠে, ‘মা…’।

তারপর অল্পক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেরিয়ে আসে একটা বছর দশ-বারোর ছেলে। হাত-পাগুলো শিরশির করে ওঠে মোহনের। এই কি তবে কাকার একমাত্র ছেলে! কাকার প্রকৃত উত্তরাধিকারী! ছেলেটি বেরিয়ে অপরিচিত ছায়ামূর্তিকে দেখে খানিক ঘাবড়ে যায়। এদিকে ছায়ামূর্তি কী যেন একটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দিতে যায় ছেলেটার দিকে। মোহন নিজেকে প্রস্তুত করেই রেখেছিল। মুহূর্তের ক্ষীপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেটার ওপর। ছেলেটাকে নিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। হাওয়ায় ভেসে যায় অঘোর তান্ত্রিকের ছোঁড়া জিনিসটা।

লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বিড়বিড় করে কী সব যেন উচ্চারণ করতে শুরু করেন তিনি। হাতে আবার কিছু একটা করার জন্য প্রস্তুত হন মোহন আর খোকনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু পারেন না। হঠাৎ একটা প্রবল হওয়ার স্রোত এসে ধাক্কা দেয় তাকে। তিনি ছিটকে পড়েন মাটিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘কে… কে… সামনে আসছিস না কেন?’ কোথাও থেকে কেউ উত্তর দেয় না। কিন্তু তাদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে একটা নারী অবয়ব। ভয়ে, বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে যায় অঘোর বাবার চোখ। ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করে বলে ওঠে, ‘রঞ্জাবতী!’

মা, মা বলে খোকন ছুটে যেতে চায় ওই নারীমূর্তির দিকে। ক্ষণিকের জন্য চমকে ওঠে মোহন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে খোকনের হাত চেপে ধরে ইশরায় বারণ করে তাকে। অঘোর তান্ত্রিক এটুকু সময়ের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে আবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ান। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, ‘আমার সঙ্গে পারবে না রঞ্জাবতী। তোমার মতো কতকে ঘায়েল করে আমি আজ এই জায়গায় পৌঁছেছি।’

অপর প্রান্ত থেকে কোনো উত্তর আসে না। নিজের স্বভাবসিদ্ধ ক্রুর হাসিটা হেসে আবার কী সব মন্ত্র জপতে শুরু করেন অঘোর তান্ত্রিক। সেই সাথে নিজের গলার থেকে একটা রুদ্রাক্ষের মালা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে দিতে যান রাঞ্জাবতীর দিকে। কিন্তু সেই মালা রঞ্জাবতীকে ছোঁয়ার আগেই আবার এক দমকা বাতাস এসে সেটার গতি ঘুরিয়ে দেয়। চমকে ওঠেন অঘোর তান্ত্রিক। মোহনও চমকে উঠে দেখে হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একরাশ ধুলো পাক খেতে খেতে একটা ঝড়ের আকার নিচ্ছে। আশেপাশের গাছগুলোও দুলতে শুরু করেছে প্রচণ্ডভাবে। মোহন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে চাঁদটার অস্তিত্বমাত্র বোঝা যাচ্ছে না। আকাশজুড়ে এখন শুধু কালো মেঘের ঘনঘটা। আকাশে কালো মেঘ তো অনেক দেখেছে মোহন কিন্তু আজকের এই ভয়ংকরী রূপ অন্যরকম। যা ঠিক ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

ঝড়ের গতি ক্রমশ বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অঘোর বাবার মন্ত্র উচ্চারণ। মাঝে মাঝে ঝোলা থেকে কী সব জিনিস বের করে ছুঁড়তে যান রঞ্জাবতীকে লক্ষ্য করে। জিনিসগুলোর সংস্পর্শে এলেই কেঁপে ওঠে তার শরীর। মোহন আশ্চর্য হয়ে দেখে রঞ্জাবতী কিছু করছেন না। তার অবয়বটা নিশ্চল। শুধু দুই বাহু দুদিকে প্রশস্ত করে সে যেন কিছুতে মনোসংযোগ করতে ব্যস্ত। খোকনের মাথাটা বুকে চেপে নিয়ে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থাকে মোহন। ঝড়ের দাপটে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকাই দায়। ওদিকে অঘোর বাবার সঙ্গে রঞ্জাবতীর এই অসম লড়াই দেখতে দেখতে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে ওঠে মোহন। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এই বুঝি শেষ। অঘোর বাবারও বোধহয় মনের ভাব খানিক সে রকমই। তার ঠোঁটের কোণে ইতোমধ্যেই ফুটে ওঠে জয়ের হাসি। তিনি আস্তে আস্তে এবার ঝোলা থেকে বের করে আনেন কিছু একটা। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারে না মোহন। অঘোর বাবা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘এবার তোমার খেলা শেষ রঞ্জাবতী…’। এদিকে খোকন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মা…’।

সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জাবতী নিজের হাত দুটো শিথিল করে দেয়। ধক করে জ্বলে ওঠে তার চোখ দুটো। তৎক্ষণাৎ বীভৎস শব্দে আকাশ থেকে নেমে আসে চোখ ঝলসানো আলো। সে আলোর তীব্রতায় চোখ বন্ধ করে ফেলে মোহন। সেই অবস্থায় কয়েক মুহূর্তের জন্য শুনতে পায় এক গগনভেদী আর্তনাদ। তারপর সব চুপচাপ। আস্তে আস্তে চোখ খোলে মোহন। চোখ খুলেই একটা বিকৃত শব্দ বের করে পিছিয়ে যায় কয়েক পা। কখন যেন রঞ্জাবতী এসে উপস্থিত হয়েছে ওদের সামনে। তার মুখটা অদ্ভুত রকমের পোড়া, যেটা দেখে ভয় পেয়ে যায় মোহন। খোকন এসব দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে খানিক আগেই। আস্তে আস্তে নিজের হাত বাড়িয়ে খোকনের মাথায় হাত ছোঁয়ায় রঞ্জাবতী। তারপর নিজের দুই হাত জোড় করে মোহনের দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকায়। মোহন জানে এই অনুরোধের অর্থ। সে মাথা নেড়ে বলে, ‘আমি ভাইয়ের খেয়াল রাখবো কাকিমা, কথা দিলাম।’

মোহনের আশ্বাসে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে রঞ্জাবতীর। সেই সাথে চোখের কোণটাও যেন চিকচিক করে ওঠে অল্প কিন্তু ভালো করে কিছু দেখার আগেই রঞ্জাবতীর সূক্ষ্ণ শরীরটা অসংখ্য জোনাকি পোকার আলোর মতো হয়ে মিশে যায় বাতাসে।

৫.ঝড় থেমে গেছে অনেকক্ষণ। অঘোর তান্ত্রিকের পুড়ে দলা পাকিয়ে যাওয়া শরীরটাকে আবার ভালো করে সৎকারের ব্যবস্থা করছে গ্রামবাসী। নিবৃত্তি আর তার দাদা অঘোর তান্ত্রিক ছিলেন রঞ্জাবতীর বাপের বাড়ির গ্রামের লোক। বাপ মা মরা মেয়ে, দাদা আবার তান্ত্রিক এই ভেবে দয়া পরবশ হয়ে নিবৃত্তিকে নিজের শ্বশুরবাড়িতে এনেছিলেন রঞ্জাবতী। কিন্তু তখন জানতেন না যে, এই অসহায় মেয়েটাই তলে তলে নিজের তান্ত্রিক দাদার সাহায্য নিয়ে এমন ভয়ানক ষড়যন্ত্রে মেতেছে। জমিদারকে বশ করে তাকে বিয়ে করে প্রথমেই সে রঞ্জাবতীকে তাড়ায় তারই নিজের বাড়ি থেকে। রঞ্জাবতী ছোট্ট খোকনকে নিয়ে চলে যান বাপের বাড়ি। কিন্তু এতেও শান্তি হয়নি নিবৃত্তির। সে বুঝতে পারে যে, জমিদারের মনের সম্পূর্ণ দখল নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কিছুতেই। যতদিন রঞ্জাবতী আর খোকন বেঁচে থাকবে; ততদিন ওদের টান জমিদার কিছুতেই কাটাতে পারবেন না। সে কারণেই নিবৃত্তি অবশেষে লোক পাঠায় রঞ্জাবতী আর খোকনকে পুড়িয়ে মারার জন্য। রঞ্জাবতী মারা গেলেও বেঁচে যায় খোকন। তাকে নিয়ে চলে যায় রঞ্জাবতীর এক নিঃসন্তান বোন। কিন্তু তাতেও রেহাই মেলেনি নিবৃত্তির হাত থেকে। সেখানেও সে লোক পাঠায় খোকনকে শেষ করতে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এবারেও বেঁচে যায় খোকন।

এরপর খোকনের সেই মাসি ভাবে, খোকনকে লুকিয়ে রাখার সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা হচ্ছে তার নিজেরই গ্রাম। নিবৃত্তি নিশ্চয়ই ভাবতেও পারবে না যে, তারই গ্রামে লুকিয়ে আছে খোকন। এদিকে এই কয়েক বছরে খোকনের শরীর অনেকটাই বেড়েছে। তাই তাকে চেনা এত সহজ হবে না। এ অবধি সব ঠিকই চলছিল কিন্তু তারপর হঠাৎ করে জমিদার মশাই জানতে পারেন রঞ্জাবতী আর খোকন মারা গেছে। এ খবরে শোকে পাগল হয়ে যান তিনি, আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তার সেই চেষ্টা বিফল হলেও অসুস্থ হয়ে সম্পূর্ণ শয্যা নেন। এদিকে কীভাবে যেন নিবৃত্তির কাছে খোকনের খবর পৌঁছে যায়। তাই সে এক অভিনব উপায়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার ছক কষে।****

টলোমলো পায়ে এগিয়ে চলছে মোহন। শরীরের ওপর অনেক ধকল গেছে। মায়ের কাছে ছন্নছাড়া ভাবে কিছু শুনেছিল। আজ খোকনের মাসির কাছ থেকে পুরোটা শুনে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেছে। ওই মহিলা এতটা ভয়ংকর! মা সার্থক সম্বোধন করতো ওকে ‘ডাইনি’ বলে। তবে এখন আর ভয় নেই কোনো। নিবৃত্তির শিরদাঁড়াটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না কোনদিন। সত্যিই মায়ের চিন্তাটা যে অমূলক ছিল না, তা এখন ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে মোহন। মায়েরা বোধহয় এমনই হন; নিজের মৃত্যুর পরেও রঞ্জাবতী ছেলের জন্য চিন্তা ছাড়তে পারেনি বলেই তো তার বিপদে আজ এভাবে এসে তাকে রক্ষা করে গেলো। হয়তো আগের বারও নিজের মায়ের অদৃশ্য রক্ষাকবচ ছিল বলেই সেবারও বেঁচে গেছিল খোকন। জ্ঞান ফিরতে খোকন বড্ড কান্নাকাটি করছিল মায়ের জন্য। অতটুকু ছেলে মাকে ছাড়া। মোহনের চোখ দুটো আচমকাই জলে ঝাপসা হয়ে এলো। তাকে ঘরে না পেয়ে তার মা-ও এতক্ষণে কত না জানি চিন্তা করছেন। চলার গতি বাড়ালো মোহন। বহুদিন পর ইচ্ছে করছে সেই ছোটবেলার মতো মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। মায়ের আঁচল টেনে আদর খেতে।

এসইউ/এমএস