একুশে বইমেলা

কাজী নজরুল ইসলামের তিনটি উপন্যাস

কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা কবি হিসেবেই জানি। বিদ্রোহী কবি হিসেবে একটু বেশি জানি। তবে কবি নজরুলের বিকাশ ঘটেছে কিন্তু কথাসাহিত্য দিয়েই। প্রথম জীবনে তিনি গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ বাদ দিলে তাঁর ‘বাঁধন-হারা’ ও ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস কবি হয়ে ওঠার আগেই লেখা। তাই বলা যায়, গল্প-উপন্যাস লেখক নজরুল কবি নজরুলের অগ্রজ। নজরুলের সাম্যবাদ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রকাশ উপন্যাসগুলোর বিভিন্ন চরিত্রের মাঝেও দেখা যায়। তাঁর চিন্তাধারার রিয়ার্সেল-গ্রাউন্ড তাঁর কথাসাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কথাসাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘ভাবের সংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধনায় এই এক নতুন অবদান আনছ তুমি।’’ কথাসাহিত্য নজরুল প্রতিভার বিশিষ্ট অবদান বিভিন্ন সংস্কৃতি-সমন্বয়ের সাধনা। উপন্যাসগুলোর কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণে তিনি যে দার্শনিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, তা বৃহত্তর মানবজীবনকে উন্মুক্ত আকাশ পানে টেনে নিয়ে যায়।

Advertisement

কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য লিখেছেন। তার প্রমাণ সৃষ্টিশীল তিনটি উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’। ‘নজরুলের গদ্যে ভিন্ন উদ্ভাস’ প্রবন্ধে কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু বলেছেন, ‘‘নজরুলের তিনটি উপন্যাস এবং এই তিনটি উপন্যাসের তিনটি চরিত্র ‘বাঁধনহারা’র নুরুল হুদা, ‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর ও ‘মৃত্যুক্ষুধা’র আনসার নজরুলের প্রতিকৃতি হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে যেন। নজরুল চরিত্রের যে রোমান্টিকতা-স্বদেশিকতা-মানবতাবোধ রয়েছে তা এই তিনটি চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘বাঁধনহারা’য় যে সৈনিক-জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে-তা উল্লেখযোগ্য এবং বিরল। ‘কুহেলিকার’ কাহিনি সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এসব উপন্যাসে আঙ্গিকগত দুর্বলতা রয়েছে ঠিকই কিন্তু কিছু চরিত্র এবং সামাজিক অবস্থানকে যেভাবে উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে-তা একেবারে মূল্যহীন নয়। কেননা যা কিছু বৈশিষ্ট্য এসব লেখায় রয়েছে তা সময় ও নজরুলের চেতনা মূল্যায়নে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়।’’

কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঁধন-হারা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস। করাচিতে থাকাকালীন তিনি ‘বাঁধন-হারা’ উপন্যাস রচনা শুরু করেন। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করে ডিম.এম লাইব্রেরি। মূল্য রাখা হয় দুই টাকা।

‘বাঁধন-হারা’ উপন্যাসে মোট চরিত্রের সংখ্যা দশটি—নুরুল হুদা, মাহবুবা, রাবেয়া, সাহসিকা, আয়েশা, খুকি আনারকলি, মা রোকেয়া, মনুয়ার, রবিউল ও সোফিয়া। রাবেয়া ও রবিউল দম্পতির শিশুকন্যা খুকি বা আনারকলি ছাড়া প্রত্যেকেই চিঠিতে নিজেদের চরিত্র ও ভাবনা ধারণ করে। নজরুল ‘বাঁধন-হারা’র মাধ্যমে বাঙালিদের প্রথম আধুনিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জ্ঞাত করেছেন। উপন্যাসে নজরুলের সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন

পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক কিছু বই  বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা: লেখকের দায়বদ্ধতা 

‘মৃত্যুক্ষুধা’ কাজী নজরুল ইসলাম রচিত আলোচিত একটি উপন্যাস। এটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে বই আকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি সওগাত পত্রিকায় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হয়। উপন্যাসটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের একটি রচনা।

উপন্যাসটি শুরু হয় মূলত একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবারের গল্প নিয়ে। যে পরিবারে রোগগ্রস্ত বৃদ্ধ মা, ৩ জন বিধবা পুত্রবধূ ও তাদের দেবর প্যাঁকালে। উপন্যাসে নজরুলের দ্বৈতসত্তার প্রকাশ ঘটেছে প্যাঁকালে ও আনসার চরিত্রের মধ্যে। আবার মেজ বউ-রুবি চরিত্রও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসের চরিত্ররা ক্ষুধার তাড়নায় ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মেজ বউকে এক যুদ্ধরত নারীর জীবন বেছে নিতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও মেজ বউকে ফিরে আসতে হয় চিরচেনা বস্তিজীবনে। সে মিশনারীদের বহু অনুরোধেও আর ফিরে যাননি। তওবা করে মুসলমানও হননি। এ উপন্যাসে যুদ্ধোত্তর সময়ের শ্রেণিবৈষম্য, অর্থসংকট, নগরচেতনার প্রকাশ পেয়েছে। এখানে দারিদ্রের চিত্র, সাম্য ও বিপ্লবীচেতনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

‘কুহেলিকা’ কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি উপন্যাস। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক নওরোজ পত্রিকায় প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পর নওরোজ বন্ধ হয়ে গেলে সওগাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসে নজরুলের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়। স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।

Advertisement

উপন্যাসে বিপ্লবী যুবক জাহাঙ্গীর চরিত্র দিয়ে সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতির সফল প্রতিফলন ঘটেছে। কাহিনির রূপরেখা সমসাময়িক হলেও লেখক কাহিনি পরিচর্যা করেছেন নিজের মতো করে। ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও প্রাণের স্পর্শের পাশাপাশি মিথ-কথনের প্রয়াস রয়েছে। পাঠককে ভাবায় জাহাঙ্গীরের জন্ম-সংক্রান্ত বিদ্রোহের বর্ণনা, বন্ধু হারুনের সাথে তার বাড়ির দিকে যাত্রার গল্প, হারুনের পাগলী মায়ের অদ্ভুত আচরণ, তার অন্ধ পিতা, খোন্দকার সাহেবসহ দুই বোনের চরিত্র। উপন্যাসের সংলাপগুলো গভীর মনস্তত্ত্বের কথা বলে। সব মিলিয়ে অন্যরকম অনুভূতির মিশেল এ কাহিনি। উপন্যাসে বর্তমান সময়ের নিম্নবিত্ত বাঙালির বাস্তব রূপই যেন ফুটে উঠেছে।

এসইউ/জিকেএস