বিএনপির চিন্তক গ্রুপের অন্যতম সদস্য শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে দুটি ধারা স্পষ্ট। একপক্ষ বলছে ৮১ বছরের প্রবীণকে এভাবে গ্রেপ্তার না করলেও হতো। তার মতো নামি-দামি সাংবাদিককে আদালতের অনুমতি ছাড়া আটক করা ঠিক হয়নি। রিমান্ডে নেওয়াও অন্যায় হয়েছে। তাকে আটক করা মানেই ভিন্নমত দমন নীতির বহিঃপ্রকাশ। আরেকপক্ষ বলছে, তিনি সাংবাদিক হোন আর যাই হোন অভিযুক্ত অপরাধী হিসেবে তাকে আটক করা যুক্তিযুক্তই হয়েছে।আমরা এরইমধ্যে জেনেছি ঠিক কী কারণে তাকে আটক করা হয়েছে। ছোট করে বললেও দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে এবং তাঁর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনায় পুলিশ গত বছরের আগস্টে পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। পরে তা মামলায় রূপান্তরিত হয়। সেই মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করে ৫দিনের রিমাণ্ডে নেওয়া হয়েছে। অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল নিউ ইয়র্কে। সেখানে এই মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। মামলার রায়ে সেখানকার বিএনপি নেতার ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারের ৪২ মাসের কারাদণ্ড হয়। এ ছাড়া ঘুষ লেনদেনের জন্য এক এফবিআই এজেন্টের বন্ধুর ৩০ মাসের কারাদণ্ড হয়।‘সজীব ওয়াজেদ জয়কে অ্যামেরিকায় হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হয় ২০১১ সালে৷ এর অংশ হিসেবে ২০১২ সালে জাসাসের (জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বাসায় একটি বৈঠক হয়৷ এতে মোহাম্মদ উল্লাহ, তাঁর ছেলে রিজভী আহমেদ (সিজার) এবং এফবিআই-এর এক প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন৷ এ বিষয়ে শফিক রেহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন। তবে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা তিনি জানতেন না বলে জানিয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে জয় সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত তথ্য পেতে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় দণ্ডিতদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের কথা শফিক রেহমান স্বীকার করেছেন। শফিক রেহমান মামলার আপডেট এখন পর্যন্ত এটুকুই। আমরা যদি উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই এখানে শফিক রেহমান আইনের দৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরো তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এরইমধ্যে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কিছু দলিল দস্তাবেজ পুলিশ তার বাড়ী থেকে উদ্ধার করেছে। সুতরাং শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা আইনের দৃষ্টিতে সঠিক এবং রিমান্ডে নেওয়াও সঠিক হয়েছে। যারা বলছেন ৮১ বছরের এই প্রবীণকে রিমান্ডে নেওয়ার কী দরকার ছিল, তাদের জন্য জবাব হলো রিমান্ডে না নিলে জনাব রেহমান তার বাড়ি থেকে স্বেচ্ছায় ওইসব দলিলপত্র পুলিশের কাছে তুলে দিতেন না। আর যারা বলছেন তার মতো একজন সিনিয়র সিটিজেন বা প্রখ্যাত ব্যক্তিতো পালিয়ে যেতেন না, আদালতের আদেশ নিয়ে এসেই পুলিশ তাকে আটক করতে পারতো। তাদের জন্য তথ্য হলো এই সিনিয়র সিটিজেন সাংবাদিকদের পাওনা না দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি যখন জানতে পারতেন তাকে আটক করার চেষ্টা হচ্ছে তখন যে আবার পালিয়ে যেতেন না সেই নিশ্চয়তা নেই। তিনি তো শুধু বাংলাদেশের ব্যাপারেই আনুগত্য প্রকাশ করেননি, তিনি বৃটিশদের প্রতিও আনুগত্য প্রকাশ করে সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। যারা বলছেন সারাদেশে এতো খুন, হত্যা হয় তাদের খুনিদের গ্রেপ্তার না করে শফিক রেহমানকে কেন ধরা হলো, তাদের জন্য জবাব হলো জমি নিয়ে মারামারি করে একজনকে খুন করা আর রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলে দেওয়ার ঘটনা একই রকম গুরুত্ব পাবে- তা হতে পারে না। আইনের চোখে সব সমান হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা আর জমি বিরোধে একজন হত্যার ঘটনা নিশ্চয় একই রকম নয়। যারা তাকে সাংবাদিক বলে মহান পেশার মানুষ বলে চিহ্নিত করছেন তাদের জন্য জবাব হলো, কোন সাংবাদিকতা বা কোন লেখার কারণে তাকে আটক করা হয়েছে? যখন একজন সাংবাদিক কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি যুক্ত হন তখন তার সাংবাদিক পরিচয়ের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ই মূখ্য হয়ে ওঠে। আসলে তখন আর তিনি সাংবাদিক থাকেন না। তার সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার নৈতিক অধিকারও থাকে না। যেমন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার নামে দায়ের মামলাগুলোর মেরিট আছে কি নেই সেই বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু তাকে সাংবাদিকতার কোনো কার্যক্রমের জন্য আটক করা হয়নি। তাদের গ্রেপ্তার করার সাথে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। শফিক রেহমানের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক মৌচাকে ঢিল বের হচ্ছে। তিনি বিএনপির কূটনৈতিক বিভাগের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সর্বশেষ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপকমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। অর্থাৎ তিনি পুরোপুরি একজন রাজনীতিবিদ। যেমন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম এক সময় বাংলার বাণী পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। এরশাদ ও খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে তাকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তখন কিন্তু আমরা কেউ বলিনি একজন সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তেমনি এখনকার বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকেও একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনিতো ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন। তিনি প্রেসক্লাবেরও সভাপতি ছিলেন। তখনও আমরা সম্পাদককে গ্রেপ্তার বা ভিন্নমত দমন বলে চিৎকার করিনি। সমস্যাটি হলো এখন সাংবাদিক আর রাজনীতিকদের মধ্যে আলাদা করা যাচ্ছে না। একদল আওয়ামী লীগ করেন, আরেক দল বিএনপি করেন। এতে করে কেউ অপরাধ করলেও অপরাধীর পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে তার রাজনৈতিক পরিচয়। আর সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা হয় সাংবাদিকের পরিচয়ের। তাই সাংবাদিকদের সকল সংগঠন এবং সরকারেরও সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের উচিত হবে যে সকল সাংবাদিক সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত তাদের সাংবাদিক পরিচয় কেড়ে নেওয়া। আমরা জানি এরই মধ্যে কয়েকশ জামায়াত, শিবির কর্মী সাংবাদিক পরিচয়ে নানা সুবিধা নিচ্ছে। তারা যেকোনো সময় বড় ধরনের অঘটনও ঘটাতে পারে। আমরা আশা করবো শফিক রেহমানের এই মামলাটি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হবে। প্রকৃত সত্য উদঘাটন হবে। তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন বলে আওয়ামী লীগ সরকার বৈরী আচরণ করবে তা প্রত্যাশিত নয়। তিনি যদি নির্দোষ হন তাহলে যেন সসম্মানে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত এই মামলার তদন্ত শেষ করতে হবে। কেননা এই মামলাটির সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, গণমাধ্যমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। তবে আমার আশঙ্কা, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় কার্যকর করতে সময় লেগেছে ৩৪ বছর, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যা চেষ্টার বিচার ১২ বছরেও শেষ হয়নি, শেখ হাসিনার ছেলে জয়কে হত্যার পরিকল্পনার মামলা কতো বছরে শেষ হবে কে জানে? লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজএইচআর/এমএস
Advertisement